অনুরাগিনী – শান্তনু মুখার্জ্জী (জয়)

****************************************

1

মেয়েটার নাম যে রাগিনী রেখেছিলো তার আর কিছু না হলেও একটা জ্যোতিষ রত্ন টাইপের কিছু পাওয়া উচিত ছিল। ছোটবেলার সেই শান্ত শিষ্ট ,সদা হাস্যময় এবং আপাত নিরীহ মেয়েটা যে বড় হয়ে এমন রাশভারী , নীতিজ্ঞান পূর্ন জাঁদরেল হয়ে উঠবে সেটা বাড়ির লোকও ধারনা করতে পারেনি। যৌথ পরিবারে কোলে পিঠে বেড়ে ওঠা রাগিনীর এই পরিবর্তন সবাই লক্ষ্য করলো সে যখন স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে মেডিকেল কলেজে ভর্তি হলো ডাক্তারি পড়বে বলে।

রাগিণীর বাবা সুধাময় সেনগুপ্ত চেয়েছিলেন মেয়ে এম বি এ করে তাদের পারিবারিক বই প্রকাশনার ব্যবসায় যোগ দিক। যেমন দিয়েছে তাঁর মেজ ভাই অর্থাৎ রাগিণীর মেজকা সুখময় সেনগুপ্তর ছেলে অনির্বান।

রাগিনী সুধাময় বাবুর মেয়ে। বাড়িতে রাগিণীর মা শর্বরী ছাড়া আর থাকে মেজকা, ভাই অনির্বান বা অনি , মেজকাকিমা সুজাতা ,ছোটকাকিমা ছন্দা , তাঁর ছেলে অর্ঘ বা গোগোল আর ঠাকুমা বিভাবতী দেবী। হ্যাঁ ঠিক ধরেছেন ছোটকাকা সাগরময় মিসিং। কেউ জানেনা তিনি কোথায়। নিন্দুকেরা বলে ছন্দার অত্যাচারে আর দুর্ব্যবহারে অতিষ্ট হয়ে তিনি গৃহত্যাগ করেছেন। রাগিণীর খুব আবছা মনে আছে ছোটকাকে। কোলে তুলে ছোটকা গান গাইত “লাল ঝুঁটি কাকাতুয়া ধরেছে যে বায়না। “

এ ছাড়া যাদের সে জন্ম থেকে দেখে যাচ্ছে তারা হলো ড্রাইভার গুরুপদ আর বিনুদা। বিনুদার কোনো নির্দিষ্ট কাজ নেই। রাগিণীর দেশের বাড়ি মেদিনীপুর থেকে গড়বেতা হয়ে এক প্রত্যন্ত গ্রাম। নাম চাঁপামুড়ি। বিনুদা সেই গ্রামেরই লোক। সুধাময় তাকে এনে রেখে দিয়েছে নিজের কাছে। ফাই ফরমাশ খাটে।

এ তো গেলো তার বাড়ির কথা। রাগিনী মেডিকেল কলেজে ফাইনাল ইয়ারে পড়ে। ডাক্তার হওয়া এবার সময়ের অপেক্ষা। বাড়িতে সাজো সাজো রব। সুখময় বাবু নিজে দাঁড়িয়ে থেকে একটা গ্যারেজ ঘর মেরামত করছেন। ওটাই হবে রাগিণীর চেম্বার।

বাড়ির ছোটবৌ ছন্দার এই গ্যারেজকে চেম্বার করাতে ঘোর আপত্তি। কিন্তু সেটা বলার মতো সাহস তার নেই। একদিন রাতে চুপি চুপি অর্ঘ্যকে সেই কথা জানালো সে। ছেলেকে একা পেয়ে সে বললো ,”নিজের অধিকার ছাড়িসনা বাবু। তোর বাপ নেই। তোকে নিজের লড়াই নিজেকেই লড়তে হবে। “

পরদিন অর্ঘ্য ঠাকুমার কাছে গিয়ে ইনিয়ে বিনিয়ে কথাটা পাড়লো। বিভাবতী দেবী বুদ্ধিমতী মহিলা। তিনি হেসে বললেন ,” এ বুদ্ধি তো তোমার নয় দাদুভাই। তোমায় এটা কেউ শিখিয়েছে। তার নামটা চটপট বলো দেখি। অর্ঘ্য অপ্রস্তুত হয়ে বললো ,” কে শেখাবে ? আমি এখন যথেষ্ট বড় হয়েছি। দিদিয়ার আজ বাদে কাল বিয়ে হয়ে শ্বশুর বাড়ি চলে যাবে। তখন কি হবে এই চেম্বারের। তার থেকে আমার কাছে থাক। আমি একটা ব্যবসা শুরু করবো। “

নাতির কথা সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে বিভাবতী দেবী রায় দিলেন ,” ওই ঘর রাগিনীই পাবে “

ঠাকুমার প্রতি একটা শ্যেন দৃষ্টি হেনে বেড়িয়ে গেলো অর্ঘ্য। সে খেয়াল করলোনা দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে পুরো কথাগুলো শুনেছে রাগিনী।

রাগিনী ডাক্তারি পাশ করেছে। বাড়িতে বড় পার্টি। কেক কাটার পর সুধাময় বাবু গ্যারাজের চাবিটা মেয়ের হাতে তুলে দিয়ে একটা ছোট খাটো বক্তৃতা দিয়ে দিলেন। কিন্তু রাগিনী যেটা করলো তার জন্য কেউ প্রস্তুত ছিল না। অর্ঘ্যকে ডেকে ওর হাতে চাবিটা দিয়ে বললো ,” আমি ঠিক করেছি আমি গ্রামে প্র্যাক্টিস করবো। শহরেতো অনেক ডাক্তার। কিন্তু অনেক গ্রাম আছে যেখানে চিকিৎসা না পেয়ে বহু মানুষ মারা যাচ্ছে। আমি সেখানে গিয়ে তাদের পাশে দাঁড়াতে চাই “

ব্যাপারটা সুধাময়ের ভালো লাগলোনা। তিনি পার্টি ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন। শুধু মেজকা সুখময় রাগিণীর মাথায় হাত রেখে বললেন ,” আশীর্বাদ করি তুমি তোমার লক্ষ্যে যেন স্থির থাকতে পারো। “

চাঁপামুড়ি গ্রামে সে কখনো যায়নি। ঠিক করলো সেখানেই যাবে। বিনুদা সব ব্যবস্থা করে দিলো।

 

2

গড়বেতা থেকে বাস ছাড়ে। সেটার একটায় চড়ে বসে সবে গল্পের বইটা বের করেছে সাথে সাথে কোত্থেকে একটা উটকো ছেলে পরনে ময়লা ধুতি আর ফতুয়া পরে এসে রাগিণীর পশে বসে পড়লো আর ব্যাগ থেকে এক টিফিন বাটি ভর্তি মুড়ি চেবাতে লাগলো। খাবার সময় সে অবলীলা ক্রমে রাগিনীকে ব্যাগটা ধরতে বলে কখনো নারকেল তো কখনো কাঁচা লঙ্কা বার করতে থাকলো।

রাগিনী এবার বেশ বিরক্তি নিয়েই বললো ,” খাওয়া হয়ে থাকলে ব্যাগটা নিয়ে নিন “

ছেলেটা বত্রিশ পাটি দাঁত বের করে ,”খুব ভারি না ?” এই বলে ব্যাগটা নিয়ে নিলো।

এটা কি খোঁচা মারলো ? রাগিনী নিজেও বুঝতে পারলো না।

রাস্তা বেশ মসৃন। হুহু করে ছুটতে লাগলো বাস| রাগিনী বই হাতে গল্পে মগ্ন। হঠাৎ ঘাড়ে কিছুর একটা স্পর্শ পেয়ে চমকে উঠলো। সেটা আর কিছুই না। ছেলেটা ঘুমোচ্ছে আর মাঝে মাঝে টাল সামলাতে না পেরে রাগিণীর ঘাড়ে মাথা দিয়ে দিচ্ছে। ডেকে তুলে কড়া ধমক দিলো রাগিনী। সুখময় আর সুধাময় বলেছিলো বাড়ির গাড়িতে আসতে। রাগিনী নেয়নি। তার জেদের কাছে বরাবরের মতো হার মানতে হলো তার বাবা ও মেজকাকে।

এর মধ্যে ছেলেটা ঘুম থেকে উঠে বসেছে। রাগিণীর দিকে তাকিয়ে একটা আড়মোড়া ভেঙে বললো ,”কটা বাজে ?”

রাগিনী মুখ না ফিরিয়েই উত্তর দিলো “তিনটে দশ “

ছেলেটি বললো ,” ওঃ তাহলে আর মিনিট কুড়িতেই চাঁপামুড়ি ঢুকিয়ে দেবে “

এবার রাগিনীকে তাকাতেই হলো।

চাঁপামুড়ি ? ছেলেটা কি সেখানেই থাকে।

একটু ইতস্ত করে রাগিনী প্রশ্ন করলো ,”আপনি চাঁপামুড়ি থাকেন ?”

ছেলেটা মাথা নেড়ে হ্যাঁ বললো।

রাগিনী জিগেস করলো , “গ্রামে হাসপাতালটা কোনদিকে জানেন ?”

ছেলেটার মুখে আবার সেই বোকা বোকা হাসি। সে বললো , ” তা জানবোনা। ওর পাশেই তো আমার স্কুল”

ততক্ষনে বাস চাঁপামুড়ি ঢুকে গেছে। দুজন মাত্র বাস থেকে নামলো। রাগিনী আর ওই ছেলেটা। বাস দুবার হর্ন দিয়ে চলে গেলো।

রাগিনী এতক্ষনে জেনেছে ছেলেটার নাম অনুব্রত। গ্রামে সবাই অনু মাস্টার বলে ডাকে। সারা গ্রামে ওই একটা মাস্টার। রাগিনী বুঝলো যে গ্রামে মাস্টার এমন সেখানে আর কি শিক্ষা থাকতে পারে।

অনুব্রত বললো ,” চলুন আপনাকে হাসপাতালে পৌঁছে দি “

রাগিনী আপত্তি জানিয়ে বললো,” না না আমি চলে যাবো “

অনুব্রত একটু হালকা হেসে বললো ,”গ্রামের নতুন ডাক্তার এসেছে। তার জন্য তো এটুকু করতেই হবে “

রাগিনী একটা তির্যক দৃষ্টি দিয়ে বললো ,”কি করে বুঝলে আমি ডাক্তার ?”

অনুব্রত একটু থেমে উত্তর দিলো ,”আপনার ব্যাগের চেনের ফাঁক দিয়ে যে কালো জিনিসটা উঁকি মারছে সেটা মনে হয়ে স্টেথোস্কোপের কানে দেবার অংশটা। “

অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলো রাগিনী। তবে কি অনুব্রতকে যে যতটা বোকা মনে করেছিল ততটা সে নয় ?

অনুব্রতর মুখে হাসি লেগে আছে। এই হাসিটা কিন্তু রাগিণীর বোকা বোকা বলে আর মনে হলোনা।

 

3

রাগিনী এখন চুটিয়ে ডাক্তারি করছে। সে বুঝেছে এ হাসপাতালের গোড়ায় গলদ। অনেক কিছু ঠিক করতে হবে। তবে একবারে নয়। আস্তে আস্তে। প্রথমে যেটা ঠিক করতে হবে সেটা হলো লোকগুলোর মানসিকতা। কারো মধ্যে কোনো কাজের উৎসাহ নেই। আড্ডার বহর দেখে হাসপাতাল না ক্লাব বোঝা দায়।

অনেক ভেবে একদিন রাগিনী সুপারের ঘরে গিয়ে সব বললো। সুপার বয়স্ক মানুষ। কিছুদিন পরেই অবসর নেবেন ভাবছেন। সব শুনে বললেন ,”আমি জানি সবই। কিন্তু কিছু করতে পারিনা। এদের গ্রুপটা বড় ভয়ানক। আর কিছু ডাক্তার আর নার্সকেও এরা দলে টেনে নিয়েছে। আমার পরেই যে সুপার হবে বলে বসে আছে সেই ডঃ নীলমনি দাস এদের কলকাঠি নাড়ে। সুপার হবার লোভে আমার বিরুদ্ধে কত উস্কেছে। এতদিন সেগুলো সামলেছি। আর পারবোনা। এবার অবসর নেবো। তুমি যা ভালো বোঝো কর। তবে সাবধানে। পরে বলোনা আমি তোমায় সাবধান করিনি।”

হতাশ হয়ে বেরিয়ে এলো রাগিনী। সে জানে যা করার তাকেই করতে হবে।

বিকেলে নদীর ধরে হাঁটতে বেরিয়ে দেখা হলো অনুব্রতর সাথে। প্রথম দর্শনে যতটা অসহ্য লেগেছিল পরে সে বুঝলো সে ততটা অসহ্য নয়। বরং এই পান্ডব বর্জিত দেশে যদি কারো সাথে দু দন্ড কথা বলা যায় তাহলে সে এই অনুব্রতই।

রাগিনী একটু ভেবে ওকেই সব খুলে বললো সমস্যার কথা। অনুব্রত একটু থেমে বললো ,” সুপারকেই কড়া হতে হবে। নাহলে কিছু করার নেই “

রাগিনী জানাল এই সুপার ভয়ে অবসর নেবে আর পরের হবু সুপার ডঃ নীলমনি দাস ওই দলের পান্ডা।

অনুব্রত হেসে বললো ,” বাঃ তাহলে তো সোনায় সোহাগা। কিছু একটা করতে হবে। এখানে হবেনা। চলুন ঘরে গিয়ে বসি। এক কাপ চা খেতে খেতে ভাবা যাবে। “

রাগিনী অন্যসময় হয়ত আপত্তি করতো কিন্তু সে এতটাই বিচলিত যে এক কোথায় রাজি হয়ে গেলো।

রাগিনীকে ঘরে তক্তপোশের ওপর বসিয়ে স্টোভ জ্বালতে রান্না ঘরে ঢুকলো অনুব্রত। রাগিনী দেখলো ঘরে আসবাবের চেয়ে বই বেশি। আর বিভিন্ন ধরনের বই। সে উঠে গিয়ে কয়েকটা বই নেড়েচেড়ে দেখতে লাগলো।

হটাৎ তার চোখে পড়লো ক্রাইম বিষয়ক একটা বই। সেই বইটা আলমারি থেকে পাড়তেই যে জিনিসটা চোখে পড়লো তাতে তার বুকের রক্ত জল হয়ে গেলো। বইয়ের পেছনে আড়াআড়ি ভাবে রাখা একটা কালো কুচকুচে পিস্তল। মুহূর্তের মধ্যে বইটা রেখে রাগিনী তাড়াতাড়ি ফিরে আসতে গিয়ে টেবিলে ধাক্কা খেয়ে ,টেবিল উল্টিয়ে কাঁচের জগ আর গ্লাস ভেঙে ফেললো।

আওয়াজ শুনে অনুব্রত দৌড়ে বেরিয়ে এলো রান্নাঘর থেকে। রাগিনী দাঁড়িয়ে রইলো হতভম্বের মতো।

যাই হোক চা খাবার সময় অনুব্রত বললো ,” আমার মনে হয় তোমাকে সুপার করে দেয়া উচিত “

রাগিনী চকিতে চোখ তুলে তাকালো। প্রথমত “তুমি শুনে আর দ্বিতীয়ত অনুব্রতর সলিউশান শুনে।

সেও এবার তুমি তে চলে গিয়ে বললো ,”তুমি কি পাগল? হাসপাতালের বোর্ডের কেউ আমায় চেনেনা। নীলমনি দাস সব সেট করে রেখেছে। ওসব ভেবে লাভ নেই। আজ উঠি “

উঠে দাঁড়ালো রাগিনী। বন্দুকের কথাটা সে ভুলতে পারছেনা।

অনুব্রত একটা স্মিত হাসি হেসে বললো ,” সুপার হলে একদিন খাইয়ো নেমন্তন্ন করে “

রাগিনী একটা ভদ্রতা রক্ষার হাসি হেসে চলে গেলো।

রাগিনী কোয়ার্টারে ফিরে আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়লো। তার খিদে নেই। বইয়ের তাকে বন্দুক এই ব্যাপারটা সে মেনে নিতে পারছেনা। কে এই অনুব্রত ? কি তার পরিচয়। তাকে সব জানতেই হবে। ঘুম আসছেনা। ঘড়ি দেখলো রাগিনী। দুটো পনেরো। একটা ট্রাকের শব্দ হলো। জানলার কাছে গিয়ে রাগিনী দেখলো ট্রাকের আলোর তীব্র জ্যোতি। সেটা দাঁড়িয়েছে হাসপাতালের পেছনের গেট-এ। তিনটে লোক বেরিয়ে এল। কিছু ওঠানো নামানো হচ্ছে। রাগিণীর কৌতূহল হলো। একটা চাদর মুড়ি দিয়ে হাতে একটা টর্চ নিয়ে রাগিনী বেরিয়ে গেলো।

হাসপাতালের পেছনে মাঠ। সেখানে একটা বড় বট গাছ। তার আড়ালে দাঁড়িয়ে রাগিনী বোঝার চেষ্টা করলো কি চলছে। প্যাকেট নামছে। একটা নয়। অনেকগুলো। তদারকি করছে ডঃ নীলমনি দাস।

ভয়ে হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছে রাগিণীর। এমন সময় সে চমকে উঠলো। তার কাঁধে একটা হাতের স্পর্শ পেয়েছে। তাহলে কি সে ধরা পড়ে গেলো ? পেছনে তাকিয়ে দেখলো একটা লোক। মাথায় হুড টানা বর্ষাতি। রাগিনী টর্চের আলো ফেললো মুখে। অনুব্রত।

রাগিনী চিৎকার করে উঠলো ,”একি তুমি ?”

অনুব্রত মুহূর্তের মধ্যে তার মুখ চেপে ধরলো। রাগিনীও আপ্রাণ চেষ্টা করলো ছাড়াতে। ততক্ষনে লোকগুলো সতর্ক হয়ে গেছে। একটাই আওয়াজ কানে এলো। “পালা “

নীলমনি দাসকেও আর দেখা যাচ্ছেনা। অনুব্রত এক ছুটে ট্রাকের সামনে গিয়ে কাউকেই পেলোনা। যেটা পেলো সেটা হলো পেটি ভর্তি ওষুধআর ইঞ্জেকশনের এম্পুল। ততক্ষনে রাগিনীও এসে দাঁড়িয়েছে। রাগিণীর দিকে তাকিয়ে অনুব্রত বললো ,” তোমার জন্য আজ শিকার ফস্কে গেলো। “তারপর পেটি গুলো দেখিয়ে সে বললো “এ গুলো কি জানো ?”

হতবাক রাগিনী জিগেস করল “কি?”

অনুব্রত যা বললো তাতে তার আর বিস্ময়ের সীমা রইলোনা। “এগুলো জাল ওষুধ ! এখানে এর একটা বড় চক্র কাজ করে। কলকাতার সাথে এদের যোগাযোগ। প্রায় ধরে ফেলেছিলাম। একটুর জন্য ফস্কে গেলো। চলো তোমায় পৌঁছে দি. তারপর এই সব পেটির ব্যবস্থা করতে হবে। “

– কে তুমি

প্রশ্নটা করলো রাগিনী।

অনুব্রত মুচকি হেসে বললো। “গ্রামের মাস্টার অনুব্রত চক্রবর্তী “

4

পরের দিন কলকাতা থেকে রিপোর্ট এলো। ওষুধগুলো সত্যি জাল। এই কলঙ্ক মাথায় নিয়ে সুপার পদত্যাগ করলেন। বোর্ড মিটিং বসল নতুন সুপার কে হবে তাই নিয়ে। নীলমনি দাস আর তার দলবল এসেছে ব্যান্ড পার্টি , মালা ,আবির নিয়ে। সুপার ঘোষণা আর মাত্র সময়ের অপেক্ষা। তারপরেই উৎসব। অনেকেই এসে তাকে অগ্রিম অভিনন্দন জানিয়ে যাচ্ছে।

যথা সময় মিটিং শেষ হলো। দরজা খুলে বেরিয়ে এলেন বোর্ড সভাপতি। এবার ঘোষণা। সবাইকে অবাক করে ঘোষণা করলেন নতুন সুপারের নাম। ডঃ রাগিনী সেনগুপ্ত ! রাগিনী নিজেও চমকে উঠেছে। ডঃ নীলমনি দাস গলার মালা ছিঁড়ে ছুটে গেলো সভাপতির কাছে। বার বার জোর করতে লাগলো নিশ্চই কোনো ভুল হয়েছে। আরেকবার যেন তিনি দেখেন। সভাপতি পরিষ্কার জানিয়ে দিলেন যে সেটাই ফাইনাল সিদ্ধান্ত। ডঃ রাগিনী সেনগুপ্তই নতুন সুপার।

ডঃ নীলমনি দাস গলার মালা ছিঁড়ে সেটাকে ছুঁড়ে ফেলে বেরিয়ে গেলেন তার দলবল নিয়ে। ফাঁকা ঘরে একা বসে রাগিনী। তাকে অভিনন্দন জানবার পর্যন্ত কেউ নেই। কিন্তু সত্যি কি কেউ নেই ? আছে। দরজার বাইরে মালা হাতে দাঁড়িয়ে অনুব্রত। নতুন সুপারকে অভিনন্দন জানাতে।

শুরু হলো জীবনের নতুন অধ্যায়। রাগিনী জানে এ পথ খুব মসৃন হবে না। বিপদ আসবে পদে পদে আর সেটা এলোও।

একদিন হাসপাতালে এসে রাগিনী দেখলো ফোর্থ ক্লাস স্টাফেরা বাইরে পথ আগলে বসে। তারা ধর্মঘট করেছে মাইনে বাড়াবার দাবিতে। এটা বছরের মাইনে বাড়াবার সময় নয়। রাগিনী বুঝলো এর পেছনে কেউ কলকাঠি নাড়ছে। প্রথমে সে বোঝাবার চেষ্টা করলো কিন্তু তাতে ফল হলো বিপরীত। বিক্ষোভ আরও বেড়ে গেলো। রাগিনীকে মাঝখানে রেখে চারদিক থেকে স্লোগান উঠতে লাগলো। রাগিনী দেখলো দূরে হাসপাতালের জানলায় চা হাতে দাঁড়িয়ে ডঃ নীলমনি দাস। বুঝতে আর বাকি রইলোনা এর পেছনে কার হাত আছে।

ঠিক সেই সময় ঘটে গেলো একটা অত্যাশ্চার্য্য ঘটনা। আরেকটা জমায়েত তৈরী হয়েছে। যার নেতৃত্বে অনুব্রত। এই জমায়েতে উপস্থিত সবার বয়েস দশের কম। এরা সবাই এই ফোর্থ ক্লাস স্টাফেদের সন্তান। তাদের দেখে বাকিরা সবাই থমকে দাঁড়ালো। একজন এগিয়ে এসে বললো ,”তোরা এখানে কেন ?”

উত্তরে কেউ বললো ,”পেটে ব্যথা ” তো কেউ বললো “বমি হচ্ছে “

অনুব্রত ভয়ে ভয়ে বললো “স্কুলে এসেই এরা শরীর খারাপ বলছে। কাল কোথায় নেমন্তন্ন খেয়েছে তারপরেই এরকম হয়েছে। কিন্তু হাসপাতাল তো বন্ধ। কি আর করি.আমি ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছি। বাড়িতে কিছু হোমিওপ্যাথি বড়ি আছে সেগুলো দিয়ে দেখি “

মুহূর্তের মধ্যে ধর্মঘট উঠে গেলো। যারা এতক্ষন রাগিনীকে ঘিরে বিক্ষোভ দেখাচ্ছিল তারাই এবার তার পায়ে পড়ে অনুরোধ করতে লাগলো একবার দেখার জন্য। একজন এগিয়ে এসে বললো ,”কাল নীলমনি দাস ছেলেমেয়েদের জন্য খাবার পাঠিয়েছিল। ওই খেয়েই হয়েছে। আপনি একটু দেখুন দিদি। আমাদের ভুল হয়ে গেছে। আর কখনো হবেনা “

রাগিনী বাচ্চাগুলোকে নিয়ে ঢুকলো নিজের কেবিনে। সাথে অনুব্রত। ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলো সে আর তারপর সবাই মিলে তালি দিয়ে উঠলো। রাগিনী কিছুই বুঝতে পারছেনা। অনুব্রত একটু হেসে বললো ,”ওদের একটু এক্টিং শেখাচ্ছিলাম আর কি ! তারপর বাচ্চাদের বললো ,” বাড়িতে বলবিনা কিন্তু। মনে থাকবে। সবাই একসাথে হ্যাঁ বলে উঠলো।

বাইরে বেরিয়ে ওরা দেখলো ত্রস্ত ভাবে বাবারা দাঁড়িয়ে। রাগিনী বললো ,”ওষুধ দিয়ে দিয়েছি। বাড়ি নিয়ে যাও “

সবাই চলে গেলে অনুব্রতও পা বাড়ালো। রাগিনী তাকে ডেকে বললো ,”শোনো “

ফিরে তাকালো অনুব্রত

রাগিনী হেসে বললো ,”থ্যাংক ইউ “

এই বোধ হয় সে রাগিনীকে প্রথম হাসতে দেখলো।

 

5

রাগিনী বুঝতে পারছে তার চারপাশের পৃথিবীটা পাল্টে যাচ্ছে। একদিকে যেমন নীলমনি দাসের বিষাক্ত নিঃস্বাসে সে হাঁপিয়ে উঠেছে ঠিক তেমনি অনুব্রতর সান্নিধ্যে সে যেন নতুন জীবন খুঁজে পেয়েছে। কি আছে অনুব্রতর মধ্যে? কেন সে তার প্রতি এমন অমোঘ টান অনুভব করে ? কেন একদিন তার দেখা না পেলে জীবন এমন বিস্বাদ হয়ে যায় ? সে জানেনা।

গত দুদিন দেখা হয়নি অনুব্রতর সাথে। সে ঠিক করলো আজ একবার স্কুলে গিয়ে দেখবে। হাসপাতালে ছুটির পর সে বেরোতে যাবে ঠিক তখনি তার ঘরে এসে ঢুকলো নীলমনি দাস। চেয়ারে বসে পায়ের ওপর পা তুলে সে বললো ,” এই যে ডঃ সেনগুপ্ত। কোথাও বেরোচ্ছেন নাকি ?”

“একটু কাজ আছে ” সংক্ষেপে উত্তর দিলো রাগিনী নীলমনি দাস একটা শ্লেষ মেশানো হাসি দিয়ে বললো,” কাজ ? কাজ মানে তো ওই মাষ্টার এর সাথে লীলা করতে যাওয়া। শুনুন এটা ভদ্রলোকের জায়গা। এখানে ওসব চলবে না “

রাগিনী এক দৃষ্টে তাকিয়ে থেকে বললো ,” আপনার কথা হয়ে গেলে আপনি এবার আসতে পারেন “

নীলমনি গলার স্বর চড়িয়ে বললো ,” না কথা শেষ হয়নি। আপনি ওষুধের সাপ্লায়ার পাল্টেছেন কাকে জিগেশ করে ?”

রাগিনী উত্তর দিলো ,” সেটা আমার ডিসিশান। আর সেখানে কেউ হাত দেয় সেটা আমি বরদাস্ত করবোনা। এবার আপনি আসুন। আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে। আর হ্যাঁ পরেরবার আমার ঘরে আসতে হলে দরজা নক করে অনুমতি নিয়ে ঢুকবেন। ” এই অবধি বলে রাগিনী সশব্দে বেরিয়ে গেলো। নীলমনি দাস চুপচাপ বসে রইলো। তার দু চোখে প্রতিহিংসার আগুন।

স্কুলে এসে রাগিনী শুনলো যে মাস্টার দুদিন হলো কলকাতায় গেছে। খুব রাগ হলো। একবার জানিয়ে যেতে পারলোনা ? আবার পরক্ষনেই সে ভাবলো ,তাকে কেন জানাবে ? আর সে এরকম প্রত্যাশাই বা করছে কেন ?

তখনো দিন শেষ হয়নি। ভালোই আলো আছে। মনে মনে ভাবলো একবার নদীর ধরে ঘুরে আসি। আজ সে একাই হাঁটছে। বড্ড বাড়ির কথা মনে পড়ছে। মা তাকে রোজ ফোন করে। কিন্তু বাবা একদিনও তার সাথে কথা বলেননি এর মধ্যে। খুব আঘাত পেয়েছেন তিনি মেয়ের সিদ্ধান্তে। মেজকা খবর নেয়। মেজকার ছেলে অনির্বান-ও মাঝে মাঝে ফোন করে। ছোটকাকিমা আর তার ছেলে গোগোলের কোনো খবর নেই। সে অবশ্য সেটা আশাও করে না। রাগিনী শুনেছে সেই গ্যারেজে গোগোল ব্যবসা শুরু করেছে।

এই সব ভাবতে ভাবতে সে অনেকটা হেঁটে চলে এসেছে। এখানে একটা বসতি আছে। সেখানে কিছু নিয়ে একটা হৈচৈ হচ্ছে। রাগিনী দেখে আসতে গেলো।

ওখানে গিয়ে যা দেখলো তাতে ও চমকে উঠলো। একজন অল্প বয়েসি বৌকে বেঁধে রাখা হয়েছে। সে ধুঁকছে। মুখ দিয়ে নাল পড়ছে আর এক ভয়ানক দর্শন ওঝা তাকে ক্রমাগত ঝাঁটার বাড়ি মেরে চলেছে কিছু দুর্বোধ্য মন্ত্র পড়ে।

জিগেস করতে একজন বললো ,”ও কানাইয়ের বৌ গো। পেত্নীতে ধরেছে। ভৈরব ওঝা ছাড়াচ্ছে “

ততক্ষনে ওঝা চিৎকার করছে ,” বল যাবি কিনা। বল”

বউটা প্রায় অজ্ঞান হয় হয়।

রাগিনী ভীড় ঠেলে এগিয়ে গিয়ে বললো ,”এটা কি করছো ?ওতো মরে যাবে। ওর অসুখ হয়েছে। কোনো পেত্নীতে ধরেনি। আমি এখনি ঠিক করে দিচ্ছি। “

ভৈরব ওঝা লাল চোখ নিয়ে বললো ,” এটা ডাক্তারের কাজ নয়। আমার কাজ আমায় করতে দাও। “

রাগিনীও নাছোড়। অবশেষে কানাই রাজি হলো।

রাগিনী ব্যাগের থেকে একটা ইঞ্জেকশান বের করে সেটা দিতেই ম্যাজিকের মত কাজ হলো। বৌ উঠে বসলো। সারা গায়ে অসহ্য ব্যথা। রাগিনী কানাইকে বললো ,”তোমার বৌয়ের মৃগী আছে। কাল হাসপাতালে ভর্তি করে দিও। “

গ্রামের সবাই রাগিনীকে নিয়ে আপ্লুত। সেও বুঝচ্ছে এদের মনের অন্ধকার কেটে যাচ্ছে। কিন্তু শত্রু সংখ্যা বেড়েই চলেছে। এবার আরেকজন বাড়লো। ভৈরব ওঝা। সে শুধু যাবার আগে বলে গেলো ,” আমার ভাত মেরে আপনিও নিশ্চিন্তে থাকতে পারবেন না। এই বলে দিয়ে গেলাম। “

 

6

গ্রামে এখন রাগিনী বেশ জনপ্রিয়। সবাই এখানে ডঃ দিদি বলে ডাকে। হাসপাতালের সাথে গ্রামের চেহারাও অনেকটা সে পাল্টে দিয়েছে। সারাদিন কাজেই ডুবে থাকে। মাঝে মাঝে বন্ধ স্কুল বাড়ির দিকে চোখ পড়ে। তালাটা আজও ঝোলানো। কোথায় গেলো অনুব্রত ?

মোবাইল নাম্বারটাও নেয়া হয়নি। সে তো ভাবেনি তাকে এমন টানা পোড়েনের মধ্যে পড়তে হবে।

সেদিন হাসপাতালে গিয়ে একটা খবর পেলো রাগিনী। ঝাড়ুদার রামদিন এসে জানালো কাল অনেক রাতে সে ভৈরব ওঝা আর ডঃ নীলমনি দাসকে হাসপাতালের পেছনে মাঠে কথা বলতে দেখেছে। আজ রাতে কিছু একটা ঘটবে।

রাগিনীর কপালে খাঁজ। কি করবে ভেবে পেলোনা। সেদিন রাতে ট্রাকের আওয়াজ আবার পাওয়া গেলো। রাগিনী একটা চাদরে আপাদমস্তক মুড়ি দিয়ে এসে দাঁড়ালো সেই বট গাছের নিচে।

ওই তো ডঃ নীলমনি দাস। ট্রাকের আলোয় দেখা গেলো একজনের হাতে কিছু দিলো। সম্ভবতঃ টাকা। ট্রাকটা এবার রওনা হবে।

ডালা বন্ধ করে তার পেছনে দুবার তালি দিলো নীলমনি। অর্থাৎ ট্রাক ছাড়ো।

ট্রাক ছেড়ে দিলো। কি করা উচিত ? রাগিনী কি পুলিশে খবর দেবে ? ঠিক সেই সময়ই একটা বাইক এসে থামলো রাগিণীর পাশে। সওয়ারীর মাথায় কালো হেলমেট। মুখ দেখা যায় না। একবার সে হেলমেটটা খুললো। অনুব্রত। এ বেশে তাকে আগে কখনো দেখেনি রাগিনী। অনুব্রত কিছু বলার আগেই রাগিনী উঠে বসলো বাইকের পেছনে। রাতের অন্ধকার চিরে বাইক ছুটলো ট্রাকের পেছনে।

দুদিকের ঘন জঙ্গল ভেদ করে ট্রাকের পেছনে বাইক ছুটেছে। জঙ্গল যেখানে আরও ঘন সেখানে হঠাৎ ব্রেক কোষে দাঁড়িয়ে গেলো ট্রাক।

অনুব্রতও দৌড়ে গিয়ে ট্রাকের ড্রাইভারকে টেনে নামালো। আর তার সাথে নামলো ভৈরব ওঝা।

“ট্রাকে কি আছে ?” লৌহ কঠিন গলায় প্রশ্ন করল অনুব্রত।

“তার আগে বোলো তুমি কে ?” ভৈরব জিগেস করলো।

এবার পকেট থেকে আইডেন্টিটি কার্ডটা বের করলো অনুব্রত। রাগিনীও দেখতে পেলো সেখানে ছবি সমেত পরিষ্কার ভাবে লেখা , অনুব্রত চক্রবর্তী , সি আই ডি ,স্পেশাল ক্রাইম সেল।

অনুব্রত ভৈরবকে বললো ট্রাকের দরজা খোলো। ভৈরব সুড়সুড় করে দরজা খুলে দিলো। অনেক পিসবোর্ডের বাক্স। তার একটা খুলতেই বেরিয়ে এলো ওষুধের স্ট্রিপ।

ভৈরবের দিকে তাকিয়ে অনুব্রত বললো ,”অনেকতো ঝাড়ফুঁক হলো। এবার একটু জেলেও তোমার জাদু দেখিয়ে এসো। “

ভৈরবের কিন্তু ভয় বলে কিচ্ছু নেই। সে বরং একবার হেসে অনুব্রতকে বললো ,” আপনার ইয়ার সেই ডাক্তার কোথায় পুলিশবাবু ?”

চমকে তাকালো অনুব্রত।

রাগিনী নেই !

অন্ধকার একটা সোঁদা ঘরে জ্ঞান ফিরলো রাগিণীর। সে জানে এখন সে বন্দি। ঘরে কিছু পরিত্যক্ত আসবাব। আর একটা বাল্ব জ্বলছে। অনুব্রত কোথায় ? সে কি বেঁচে আছে ? সি আই ডি জানার পর তাকে কি আর নীলমনি দাসের দলবল বাঁচিয়ে রেখেছে ? চোখ বুঁজে এলো রাগিণীর।

এমন সময় পায়ের শব্দে সে চমকে উঠলো। কেউ একজন আসছে। এবার দরজাটায় খুট শব্দ হল। লক খোলার ঘরে ঢুকলো নীলমনি দাস।

রাগিণীর সামনে গিয়ে একটা ছোট টুলে বসলো। তারপর নিচু গলায় বললো ,” কেমন আছেন ম্যাডাম? টিকটিকি সাজার স্বপ্ন মিটেছে ? আপনার নাগরকে এতক্ষনে ভৈরব বিষ কাউটে দিয়ে সাবাড় করে দিয়েছে। এবার তোমাকেও এখানে মেরে শিলাবতী নদীতে ভাসিয়ে দিলেই ল্যাঠা চুকে যায়। সব জায়গায় না মাতব্বরি করতে নেই। এটা আমার এলাকা। “

রাগিনী চিৎকার করে উঠলো ,” মারলে মেরে দে ! বাঁচিয়ে রেখেছিস কেন আমায় ?”

নীলমনি একটু হেসে বললো তাই করলেই ভালো হত। কিন্তু আমার পার্টনার আসছে কলকাতা থেকে। ওর একবার মতামতটা নিয়ে নি। তবে ও আমার চেয়েও ভীতু। ও যদি জানে যে তুমি আমাদের জাল ওষুধরর ব্যবসার ব্যাপারে জেনে গেছো তাহলে ও আর দেরি করবেনা। নিজে হাতেই তোমায় খতম করে দেবে। তাই বলছিলাম……”

কথা শেষ হলোনা। একটা গাড়ি এসে দাঁড়াবার শব্দ।

নীলমনি দাস বললো ,”ওই এসে গেছে “

আবার পায়ের শব্দ। দরজার বাইরে সেই শব্দ থামলো কিছুক্ষনের জন্য। এবার দরজা খোলার আওয়াজ এলো। রাগিনী দেয়ালের দিকে মুখ করে বসে।

আগন্তুক ঘরে ঢুকেছে। এবার তার গলার আওয়াজ পাওয়া গেলো। নীলমনি দাসের উদ্দেশ্যে সে বললো ,”এর কথাই বলেছিলে ?”

নীলমনি মাথা নেড়ে হ্যাঁ বললো।

-কই দেখি

এই কথাটা আগন্তুক বললো রাগিণীর উদ্দেশ্যে। রাগিনী চমকে উঠলো। এ গলা তার খুব চেনা। চকিতে ঘুরে তাকালো সে। যাকে দেখলো তাতে তার মনে হলো তার ওপর একশোটা বজ্রপাত ঘটলো। বিস্ময়ে ,বেদনায় মিশ্র এক অনুভূতি নিয়ে রাগিনী দেখলো তার সামনে যে দাঁড়িয়ে আছে.যে তার মৃত্যুর পরোয়ানায় সিলমোহর দিতে এসেছে ,সে আর কেউ নয়। তার ছোট ভাই অর্ঘ্য সেনগুপ্ত বা তার গোগোল।

গোগোলকে দেখে যে সে খুব অবাক হয়েছে বলে মনে হলোনা। সে যেন জানতোই যে যাকে ঘিরে এতো নাটক সে তারই দিদিয়া রাগিনী।

রাগিনী বরং গোগোলকে দেখে প্রথমে বাকরুদ্ধ হয়ে গেছিলো আর তারপর ভাবল তার ভাই কোনো ভাবে খবর পেয়ে তাকে উদ্ধার করতে এসেছে। তবে তার সেই ভ্রম বেশিক্ষন টিকলো না কারণ সেই ভাই নির্লিপ্ত মুখে আদেশ দিয়ে গেলো ,”আজ রাতটা এখানেই বাঁধা থাক। কাল দেখা যাবে। “

বৃষ্টির তেজটা সম্ভতঃ বেড়েছে। গাড়ি থেকে বেরিয়ে এই ঘর অবধি আসতে গোগোল পুরো ভিজে গেছে। সে আর না দাঁড়িয়ে বেরিয়ে গেলো। যাবার আগে বলে গেলো ,” একজন পাহারা বসিয়ে দাও “

নীলমনি দাস কোত্থেকে একটা ষণ্ডা মার্কা লোককে এনে বললো ,”এখানে বসে পাহারা দিবি। ঘুমোবি না “

লোকটা হাঁ জি বলে টুলে বসে খৈনি ডলতে লাগলো। নীলমনি দাস বেরিয়ে গেলো।

রাত কটা রাগিনী জানেনা। বাইরে থেকে ঝিঝি ছাড়া আরেকটা শব্দ আসছে। সেটা হলো বৃষ্টির। এর সাথে আরেকটা শব্দ যোগ হলো। সেটা হলো জলস্রোতের।

ঠিক সেই সময় আর একটা লোক এসে খবর দিলো ষণ্ডা প্রহরীটাকে যে নদীর অস্থায়ী বাঁধ ভেঙে গেছে। হুহু করে জল ঢুকছে আর এই ঘরটা আন্ডারগ্রাউন্ড হবার দরুন এখুনি জলে ভর্তি হয়ে যাবে তাই পালানোটাই শ্রেয়। প্রহরী বললো পালাবার হুকুম নেই।

লোকটা এবার একটা মোক্ষম চাল খেললো। এ বললো ,”আরে আপনি বাঁচলে বাপের নাম। মেয়েটাকে বেঁধে রেখে পালিয়ে চল। “

লোকটার বুদ্ধিটা মনে ধরলো প্রহরীর। রাগিণীকে আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে তারা পালাল।

এর মধ্যে জল ঢুকতে শুরু করেছে। রাগিণীর পায়ের পাতা ছাপিয়ে জল বইছে। এযে নিশ্চিত মৃত্যু। রাগিণীর বন্ধন না খুললে সে একবিন্দু নড়তে পারবেনা। কিন্তু কে এখানে তার বাঁধন খুলবে ? রাগিনী প্রমাদ গুনলো আর ঠিক তখনি সে অনুভব করলো দড়িতে হালকা টান। চমকে সে পেছনে তাকালো। একজন বয়ষ্ক মানুষ। সারা মুখে বহুদিনের না কাটা দাড়ি গোঁফ। সে ঝুঁকে একটা একটা করে রাগিণীর বাঁধন খুলে দিয়ে বললো ,”পালা….. পালা এখান থেকে !”

রাগিণীর মুখ থেকে সবিস্ময়ে বেরিয়ে এলো ,”ছোটকা তুমি ?”

 

 

7

 

ছোটকা ডাক শুনে আগন্তুক একটা কৌতূহলী দৃষ্টি দিলো। যেন বহুদিনের পরিচিত কাউকে চেনার চেষ্টা করছেন। রাগিনী উত্তেজিত হয়ে বললো ,”আমায় চিনতে পারছোনা ছোটকা। আমি তোমার সুমি।”

রাগিণীর মনে আছে ছোটকা তাকে এই নামেই ডাকতো।

এদিকে আগন্তুকের-ও সব মনে পড়ে গেছে। আর কোনো ভুল নেই। ইনি সেই হারিয়ে যাওয়া ছোট ভাই সাগরময়। সাগরময় রাগিনীর হাত দুটো ধরে কান্নায় ভেঙে পড়লেন । আজ কত বছর তিনি গৃহবন্দী। রাগিনী জানতে পারলো যে এই জাল ওষুধের কারবারের মাথা ডঃ নীলমনি দাস আর কেউ নন। গোগোলের এক দূরসম্পর্কের মামা আর তিনিই গোগোলকে এ পথে এনেছেন। তাকে রাগিনী কেন ও বাড়ির কেউ কখনো দেখেনি একমাত্র সাগরময় ছাড়া। সবাই জানত ছন্দার এক ডাক্তার ভাই আছে। কিন্তু সে বিদেশেই থাকে আর খুবই কম দেশে আসে। কিন্তু আসল ঘটনা হলো নীলমনি কখনো মেদিনীপুর ছেড়ে কোত্থাও যায়নি। পুরো জিনিসটাই চোখে ধুলো দিতে আগাগোড়া নাটক সাজিয়েছিলো। নীলমনি ছন্দার বাবা-কে মামা বলে ডাকতো। ছন্দার বাবা ছিলেন বায়ো কেমিস্ট। এক দুরারোগ্য ওষুধের ফর্মুলা বের করেছিলেন। নীলমনি ডাক্তার হবার সুবাদে এই গবেষণায় সাহায্য করেছিল ছন্দার বাবা ডঃ নির্মল মল্লিককে। ডঃ মল্লিক পরে নীলমনির নানা বদগুণের কথা জানতে পারেন ও তারপর বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেন। এরপরেই ছন্দার বিয়ে হয় সাগরময়ের সাথে। ডঃ মল্লিক না চাইলেও ছন্দা কিন্তু যোগাযোগ রেখে গেছিলো নীলমনির সাথে। গোগোল যখন খুব ছোট তখন নীলমনি সাগরময়কে দলে টানতে চেষ্টা করে। সাগরময় “না“ বলে দেয়। এরপর শুরু হয় ছন্দার মানসিক নির্যাতন। সাগরময় পুলিশে যাবে ভেবেও যাননি কারণ ছন্দার ক্ষতি হবে মনে করে। কিন্তু নির্যাতন যখন চরমে উঠলো একদিন সাগরময় চুপি চুপি বেরিয়ে গেলেন থানার উদ্দেশ্যে। মাঝ পথে কিডন্যাপ করে নীলমনি আর তার দলবল। সেই থেকে আজ প্রায় কুড়ি বছর তিনি মেদিনীপুরের এই প্রত্যন্ত গ্রামে গৃহবন্দী।

সাগরময় বললেন ,” পালা সুমি। আমার কথা ভাবিস না। আমার এই অন্ধকার কুঠুরিতে থাকা অভ্যেস হয়ে গেছে।”

রাগিনী স্পষ্ট ভাবে জানিয়ে দিলো যে সে ছোটকাকে না নিয়ে ফিরবেনা।

একটা সরু গলি পেরিয়ে দুজনে এসে দাঁড়ালো একটা ফাঁকা জায়গায়। জল আরও বাড়ছে। হাঁটুর ওপরে উঠে গেছে জল। হঠাৎ রাগিনী দেখলো সামনে একটা সিঁড়ি।

আর ভাবার সময় নেই। সিঁড়ি দিয়েই উঠতে শুরু করলো দুজন।

রাগিনী চাপা গলায় সাগরময়কে বললো ,”মনে হচ্ছে লোকগুলো পালিয়েছে। কিন্তু নীলমনি আর গোগোল কোথায় ?”

সিঁড়ির ওপরে ল্যান্ডিংয়ের পাশে একটা ঘর। তার মধ্যে ক্ষীণ আলোয় দেখা যাচ্ছে দুটো ছায়া মূর্তি।

এগিয়ে গিয়ে দরজায় কান লাগলো রাগিনী। ভেতর থেকে চাপা আওয়াজ আসছে। এই গলা সে চেনে। ডঃ নীলমনি দাস। ভাগ্নে গোগোলকে উদ্যেশ্য করে ভর্ৎসনার সুরে সে বলছে –

“পুলিশ কি করে খবর পেলো ?”

এবার গোগোলের গলা।

“সেটা আমি কি করে জানবো। আজ সকালে বাড়ির গ্যারেজ রেড হয়েছে। ওষুধ ,এমপিউল সব নিয়ে গেছে। গ্যারেজ সিল। উফফফ ! কি যে হবে আমি ভেবে পাচ্ছিনা”

নীলমনি আবার বললো ,”দিদি কোথায় ?”

গোগোল জানালো সে জানেনা। বাড়িতে পুলিশ ঢুকতে দেখে সে পেছনের দিকের পেঁচানো সিঁড়ি দিয়ে পালিয়ে এসেছে।

নীলমনি দাস বুঝতে পারছে যে তারা ভালোই ফেঁসেছে। পালানো ছাড়া কোনো উপায় নেই। গোগোলকে সে বললো , “যে ভাবে জল বাড়ছে তাতে একটু পরেই এই ঘর ডুবে যাবে। এখনই পালতে হবে। কোনোভাবে বর্ডার পেরিয়ে নেপাল বা বাংলাদেশে ঢুকে পড়াটাই এখন একমাত্র কাজ। তারপর দু দেশের পুলিশে সমঝোতা হতে হতে আরেকটু সময় পেয়ে যাবো। “

গোগোল নিচু গলায় বললো ,”কিন্তু ব্যাপারটা খুব গোপনে করতে হবে। মেদিনীপুর থেকে বর্ডার অনেক দূর। এর মধ্যে ধরা পড়ে গেলেই সব শেষ।”

নীলমনি বললো ,”সে আর বলতে। আর যদি কেউ আমাদের প্ল্যান জেনে যায় তাহলে তাকে ওখানেই খতম করে দিতে হবে। যেমন এই দুজনকে। ”

এই বলে হঠাৎ দরজা খুলে একটানে রাগিনী আর সাগরময়কে ভেতরে টেনে আনলো। “

ঘটনার আকস্মিকতায় থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে রইলো দুজন। নীলমনি বলে চললো ,”আমি গন্ধ পাই। শিকারের গন্ধ। তোমরা ভুল জায়গায় হানা দিতে এসেছিলে। এবার বলতো। বাড়িতে পুলিশ কে পাঠালো? একটু চালাকি যদি করেছো তাহলে এই পকেটের বন্দুকটা আর পকেটে থাকবেনা। দুটো গুলি অকারণ খরচা হবে।”

গোগোলকে দেখে আর্তনাদ করে উঠলো সাগরময়। ”তুই আমার ছেলে। কিন্তু একি সর্বনাশের দিকে পা বাড়িয়েছিস। আমাকে মেরে কেন ফেললি না ? তাহলে তো এই দিনটা আর দেখতে হতোনা।”

নীলমনি বললো ,”তোমার ওই ইচ্ছেটাও পূর্ন করবো। শুধু বলে দাও ফর্মুলাটা কোথায় ? “

সাগরময় অবিশ্বাসের সুরে বললো ,”আগেও বলেছি আমার কাছে কোনো ফর্মুলা নেই। ”

-“আলবাত আছে ” চিৎকার করে উঠলো নীলমনি। মামা মৃত্যুর আগে স্বীকার করে গেছেন যে ফর্মুলাটা উনি তোমায় দিয়ে গেছেন। আমি জানি মামা কত বড় বৈজ্ঞানিক ছিল। ওই ফর্মুলা হাতে পেলে আমি বড় ওষুধের কারখানা খুলতাম এ পাপের রাস্তায় আমাকে আসতে হতোনা। কিন্তু মামা আমায় বিশ্বাস করলেননা। তোমায় দিয়ে গেলেন। “

সাগরময় বললো ,”ও তাই আমাকে কিডন্যাপ করেও এতদিন বাঁচিয়ে রেখেছো ? ওই ফর্মুলার আশায় ? শুনে রাখো নীলমনি। ওই ফর্মুলা তুমি কোনোদিন পাবেনা।”

নীলমনি এবার পাগলের মত চিৎকার করে উঠলো ,” তাহলে মরো এই বার। পুলিশ সব জেনে গেছে। আর তোমাকে বাঁচিয়ে রাখলে আমার বিপদ বাড়বে। সঙ্গে এই খুকুমনিকেও সবাড় করে দেব। তারপর সোজা বর্ডার। ”

নীলমনির হাতে বন্দুক এসে গেছে। ল্যাচটায় টান দিলো। ট্রিগারে আঙ্গুল। গুলি বেরোতে আর একটা চাপের অপেক্ষা। আর ঠিক সেই সময়েই ঘটে গেলো ধুন্ধুমার কান্ড।

একটা কান ফাটা গুলির শব্দে চমকে উঠলো সবাই। চোখ গেলো দরজার দিকে। সেখানে পিস্তল হাতে দাঁড়িয়ে অনুব্রত। নীলমনির হাতের পিস্তল তখন ছিটকে পড়েছে মাটিতে। হাতে গুলি লেগেছে। যন্ত্রনায় কাতরাচ্ছে সে। গোগোল এদিক ওদিক দেখে পালতে গেলো। কিন্তু পারলোনা। দরজা আটকে দাঁড়িয়ে অনুব্রত ছাড়াও আরেকজন। গোগোলের মা ছন্দা। গোগোল চিৎকার করে বললো ,”মা সরে যাও।”

ছন্দা গোগোলকে জড়িয়ে ধরে বললো ,”যাসনা বাবু। সারেন্ডার কর। জীবনে অনেক পাপ করেছি আমরা। তোর বাবাকে হারিয়েছি সারা জীবনের মত। আর না। পুলিশে খবর আমিই দিয়েছিলাম।এই মানসিক চাপ আর নিতে পারছিলামনা। তুই আমায় কখনো বলিসনি তোর বাবা বেঁচে আছে। কিন্তু যখন জানতে পারলাম তখন আবার সব নতুন করে শুরু করার খুব সাধ হলো। কি পেলাম এই সব করে ? “

গোগোলের চোখ রক্তবর্ণ।” কে বললো তোমায় বাবা বেঁচে আছে ?”

-“আমি বলেছি ” কথাটা ভেসে এলো অন্ধকার থেকে। আরেকজন এসে দাঁড়িয়েছে। ভৈরব।

নীলমনি চিৎকার করে উঠলো ,”বিশ্বাসঘাতক ! তোকে এই জন্য পুষেছিলাম ?”

ভৈরব গলার স্বর কঠিন করে বললো ,”বিশ্বাসঘাতক আমি না তুমি ? আমার নাম পুলিশে কেস ঝুলিয়ে তোমরা পালাবার মতলব করেছিলে সব টাকা কড়ি নিয়ে। আমায় অনুব্রত বাবু সব বলেছেন। আজকের পুলিসের এই রেডের জন্য আমিই ওদের সাহায্য করি। কখন কোথায় ট্রাক যাবে তার সব খবর আমিই দি। আমায় তোমাদের কিচ্ছু জানতে দিইনি। কলকাতা থেকে আমি ওদের নিয়ে আসি। গোগোলের মা আমার সাথেই ট্রাকে ছিল। আর এই ঘর আমিই চিনিয়ে আনি। “

নীলমনি এবার একটা অদ্ভুত কথা বললো।

-“সবই তো বুঝলাম। কিন্তু আমার বিরুদ্ধে প্রমাণ কি ?আমি যদি বলি তোকে আমি চিনিনা। ”

এবার রাগিণীর পালা। তার শুকনো মুখে হাসি ফিরে এসেছে। সে ব্যঙ্গ করে বললো,“প্রমান তো আমার কাছে। ” এই বলে সে ব্যাগের ভেতর থেকে তার মোবাইলটা বের করে একটা বোতাম টিপতেই শোনা গেলো একটু আগে ঘরের ভেতর নীলমনি আর গোগোলের কথোপকথন।

গোগোল মাথায় হাত দিয়ে মাটিতে বসে পড়েছে। নীলমনির মুখ বিবর্ন। অনুব্রতর ইশারায় ঘরে ঢুকে এলো পুলিশ বাহিনী। গোগোল আর নীলমনির হাতে হাতকড়া লাগিয়ে নিয়ে গেলো। ভৈরব আর ছন্দাও গ্রেপ্তার হলো কিন্তু পুলিশকে সাহায্য করার জন্য তাদের সাজা কম হবে। রাগিনী সাগরময়কে নিয়ে বাইরে এসে দেখলো সুখময় ,সুধাময় ,অনির্বান সবাই এসেছে।বৃষ্টি ধরেছে। এখন ঝিরঝির করে পড়ছে।

প্রিসন ভ্যানে ওঠার আগে ছন্দা সাগরময়ের কাছে ক্ষমা চাইলো। ছোট ভাইকে পেয়ে তখন বড়ো দুই ভাই আনন্দে আত্মহারা। রাগিনী ছন্দাকে বললো, “কাকিমনি বিশ্বাস করো তোমার ওপর আমার আর কোনো রাগ বা অভিমান নেই। অনুতাপের আগুনে দ্বগ্ধে তুমি এখন শুদ্ধ হয়েছো। আমি জানি গোগোলের হয়ত জেল হবে। কিন্তু যখন ও ফিরে আসবে তখন ও একজন অন্য মানুষ হয়ে ফিরবে। আমরা আবার ওকে আপন করে নেবো।” গোগোলের মাথায় হাত রাখলো রাগিনী। গোগোলের চোখের কোণে জল চিকচিক করে উঠলো।

প্রিসন ভ্যানটা বেড়িয়ে গেলে অনুব্রত সুখময়কে গিয়ে বললো , “আরেকজনকে গ্রেপ্তার করা বাকি আছে। যদি আপনি অনুমতি দেন তাহলে আমি আপনার মেয়ে রাগিনীকে চির জীবনের মতো গ্রেপ্তার করতে চাই। আমার স্ত্রী হবার যাবজ্জীবন সাজা নিতে ওরও বোধহয় আপত্তি হবে না। “

সুখময় মেয়ের দিকে একটা কৌতুক মেশানো দৃষ্টি দিয়ে বললো ,”কি রে গ্রেপ্তারের আদেশ দিয়ে দেব ?”

রাগিনী লজ্জায় মুখ নিচু করে বললো ,”জানিনা। যা ইচ্ছে তাই করো।”

অনির্বান এতক্ষন সব দেখে এবার মুখ খুললো। দিদির কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে চাপা গলায় বললো ,”তোদের এই ব্যাপারটা নিয়ে একটা দারুন সিনেমা হয় কিন্তু। ভাবছি আমিই বানাবো সিনেমাটা।”

সুধাময় ছেলের কথায় হেসে বললো ,”কথাটা মন্দ বলিসনি অনি। তা কি নাম দিবি সিনেমাটার ?”

অনির্বান বিড় বিড় করে বললো ,”অনুব্রত আর রাগিণীর গল্প। কি নাম দেয়া যায় ? কি নাম দেয়া যায়?”

তারপরেই ওর চোখে একটা ঝিলিক খেলে গেলো। একটা তুড়ি মেরে ইউরেকার ভঙ্গিতে বললো ,”পেয়ে গেছি !”

সবাই প্রায় সমস্বরে জিগেস বলে উঠলো “ কি ?”

অনির্বান একটা গর্বিত হাসি হেসে একদিকে অনুব্রত আর আরেক দিকে রাগিনীকে নিয়ে মুচকি হেসে বললো, “ অনুরাগিণী !”

*****************************************

শান্তনু মুখার্জ্জী (জয়)

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *