******************************************************************************************************************************************
রাস্তার ধারে আগাছার মধ্যে ভাঙাচোরা পুরোনো সাহেবি বাংলোটা এ অঞ্চলে খুব বিখ্যাত। বিখ্যাত না বলে কুখ্যাত বলা আরো ভালো। সন্ধ্যের অন্ধকার নামলে ভুলেও ওর পাশ দিয়ে কেউ যায় না। কারণ ওই বাড়িতে একজন থাকেন। স্বশরীরে নয়। অ-শরীরে। তাঁর নাম ফিলিপ থমসন। একসময় পুলিশের বড়কর্তা ছিলেন। ইংরেজ আমলে বিপ্লবী নকুল সামন্তর গুলিতে প্রাণ হারান। এর ফলে নকুল সামন্তর ফাঁসি হয়।
এ বাংলোতেই সাহেব থাকতেন। তাঁর শেষ ইচ্ছে অনুযায়ী তাঁকে এই বাড়ির পেছনের বাগানে কবর দেয়া হয়। তারপর এ বাড়ির ভেতরে অনেকে বুটের শব্দ থেকে শুরু করে গুলির শব্দ পর্য্যন্ত পেয়েছে।
থমসন সাহেব এখন থমসন সাহেবের ভূত বলে পরিচিত। বহুদিন আগে একবার একজনকে দর্শন দিয়েছিলেন। তাঁর নাম গোবিন্দ ভট্টাচার্য। পাড়ার মন্দিরে পুজো করেন। খুব সাধাসিধে অমায়িক লোক। ভূতে খুব ভয়। থমসন সাহেব ভেবে চিন্তে তাকেই দেখা দিলেন। এ ব্যাটা নিশ্চয়ই ভিরমি খাবে আর নেটিভ গুলো জানতে পারবে গুলি করে দোর্দন্ডপ্রতাপ পুলিশ অফিসার থমসনকে সরানো যায় না। দেশ স্বাধীন হয়েছে তো কি হয়েছে।?
থমসন মানুষ না হোক, ভূত হয়ে ভারতেই থেকে গেছেন। আর তাঁর মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে মাঝে মাঝে রাতের বেলায় যারা ওই পথ দিয়ে যায় তাদের টুঁটি টিপে মেরে ফেলেন। অবশ্য গোবিন্দ ভট্টাচার্যকে সে মারেনি। ভয় দেখিয়ে ছেড়ে দিয়েছিল । কারণ তাঁর পুলিশি বুদ্ধি খাটিয়ে সে বুঝেছিল যে কয়েকজন কে মারলে হবে না। ছেড়ে দিতে হবে। যারা ফিরে গিয়ে প্রমাণ দেবে থমসন সাহেবের ভূত সত্যি আছেন।
তাঁর বুদ্ধি কাজে লেগেছিল। গোবিন্দ ভট্টাচার্য ভিরমি খেয়েছিলেন। আর তাঁর জ্ঞান আসতে তিনদিন লেগেছিল। জ্ঞান আসার পরেও মাঝে মাঝে “ওরে বাবা । গেলুম রে। মেরে ফেললে গো।” এই সব বলে আবার জ্ঞান হারাচ্ছিলেন। তিনদিন তিন রাত এ ভাবে কাটিয়ে শেষে মারা যান গোবিন্দ ভট্টাচার্য। এই ভাবে থমসন সাহেবের ভূত প্রবাদ থেকে সত্যিতে পরিণত হয়েছিল।
তারপর অনেকদিন চলে গেছে। পাড়ায় বহুতল বাড়ি হয়েছে। থমসন সাহেবের ভূতের ব্যপারটা এখন অনেক ইয়াং ছেলে মেয়ে গুজব বলে উড়িয়ে দেয়। এই কারণে থমসন সাহেবের ভূত একটু মনকষ্টে আছেন। তাছাড়া উনি সাহেব। লোকে কেন ওনাকে ভূত বলবে। থমসন সাহেবের গোস্ট বলা উচিত। ভূত, আত্মা এসব বড্ড নেটিভ মার্কা। কিছু একটা করা দরকার। তাঁর লুপ্ত গৌরব ফিরে পেতে হবে। কিছু একটা করতে হবে। কি করবেন ? আবার কাউকে ভয় দেখাতে হবে। দরকার হলে ঘাড় মটকাতে হবে। না না। ঘাড় মটকাবেন কি? ওটাও খুব দিশি স্টাইল। কিছু বিদেশি কায়দা ভাবতে হবে। তার আগে দরকার একটা শিকার। আর আজকেই তার উপযুক্ত দিন। কারণ আজ ফ্রাইডে দা থার্টিনথ। বিদেশি ঘোস্ট দের জন্য এর চেয়ে ভালো দিন আর হয় না। আজই কাউকে সাবাড় করতে হবে। তাহলেই তাঁর অস্তিত্ব ঘোষণা করা যাবে। কিন্তু সমস্যা একটাই। রাত হলে এই বাড়ির পাশে কেউ আসবে না। তাহলে শিকার পাবেন কি করে ? যাই হোক আজ একবার চেষ্টা করে দেখবেন।
সন্ধ্যা নামতেই থমসন সাহেব এসে দাঁড়ালেন বাংলোর ন্যাড়া ছাদে। পরিকল্পনা হচ্ছে যেই একজন রাস্তা দিয়ে যাবে ওমনি থমসন সাহেব শূন্যে উড়ে গিয়ে তার সামনে দাঁড়িয়ে ড্রাকুলার মত তার গলা দাঁত বসিয়ে হত্যা করবে। ব্যাপারটা ভাবতেই থমসন সাহেবের শরীরে শিহরণ খেলে গেল।
রাত আরেকটু বাড়ল। দুটো প্যাঁচা বেদম চেঁচাচ্ছে।
এই সময় থমসন সাহেব দেখলেন রাস্তায় একটা লোক। একদম পাক্কা নেটিভ। হাঁটুর ওপর ধুতি, গায়ে ধূসর চাদর। লোকটা দ্রুত পায়ে এগিয়ে চলেছে। সাহেব ভাবলেন যতই সে তাড়াতাড়ি পা চালাক আজ আর ওর নিস্তার নেই।
লোকটা বাংলোর কাছে আসতেই হাওয়াতে গা ভাসিয়ে দিলেন থমসন সাহেব। একটা ঝড়ে উড়ে যাওয়া পাতার মত ভেসে এসে দাঁড়ালেন লোকটার সামনে। লোকটার মাথায় চাদর। সেটা ভেদ করে থমসন সাহেব তাঁর ধারালো দাঁত বসিয়ে দিলেন লোকটার গলায় এক মুহূর্ত বিলম্ব না করে।
এতক্ষনে তাঁর রক্তের স্বাদ পাবার কথা ছিল। কিন্তু না। সেটা তিনি পেলেন না। বরং দাঁতটা কিছুতে একটা বাধা পেয়েছে। কি ওটা যে তাঁর ভুতুড়ে দাঁত ভেদ করতে পারলো না। লোকটা ততক্ষনে চাদর সরিয়ে দিয়েছে। অপার বিস্ময়ে থমসন সাহেব দেখলেন যে যাতে তাঁর দাঁত বাধা পেয়েছে সেটা একটা মোটা দড়ি যেটা লোকটার গলায় আষ্টেপৃষ্টে প্যাচানো।
দু পা পিছিয়ে এলেন থমসন সাহেব। লোকটাকে চিনতে পেরেছেন তিনি। এ আর কেউ নয়।বিপ্লবী নকুল সামন্ত। যার গুলিতে সাহেবের পঞ্চত্তর প্রাপ্তি ঘটেছিল আজ থেকে পঁচানোব্বই বছর আগে। আর গলার দড়িটাও তিনি চেনেন। তাঁরই জেলের ফাঁসির দড়ি।
এসব ভাবতে ভাবতেই সাহেব দেখলেন নকুল একদম তাঁর মুখোমুখি এসে পড়েছে। এরকম জায়গা থেকেই গুলিটা চালিয়েছিল সে। আজও সে হাত বের করেছে। তবে সে হাতে বন্দুক নেই। আছে কিছু ধারালো নখ। সেই নখ দিয়ে নকুল থমসন সাহেবের ঘাড় চেপে ধরল। থমসন সাহেব ব্যথায় ছটফট করে উঠলেন।
নকুল বললো, “সাহেব শুধু ফ্রাইডে দা থার্টিনথ টাই মনে রাখলেন আর এটা ভুলে গেলেন আজ ভূত চতুর্দশী। আজ দেখবেন দেশি ভূতের তেজ।
“ওহ সেভ মি সেভ মি” বলে দৌড় লাগলেন থমসন। তিনি আর উড়তে পারছেন না। ভূতের সামনে।ঘোস্ট বিদ্যা কাজ করছে না। বেশি দূর পালাতে পারলেন না কারণ সেখানে আর একজন দাঁড়িয়ে। গোবিন্দ ভট্টাচার্য। তাঁর মুখেও প্রতিহিংসার হাসি। সামনে গোবিন্দ পেছনে নকুল। দিশাহারা থমসন সাহেব কি করবেন বুঝতে না পেরে হাঁটু মুড়ে বসে পড়লেন। তারপর হাত দুটো ওপরে তুলে “mercy mercy” বলে চিৎকার শুরু করলেন।
নকুল বললো, “কোনো mercy নেই। আজ আবার তুই ভূত হয়েও আমার হাতেই মরবি।”
গোবিন্দ ভট্টাচার্য বললেন, “ছেড়ে দাও নকুল । ঢের শিক্ষা হয়েছে ওর।” তারপর সাহেবের দিকে ঘুরে বললেন, “এবার আপনি কাটুন দেখি। আর যেন এখানে দেখতে না পাই।”
এ কথা শোনা মাত্রই থমসন এক ছুটে হাওয়ায় মিলিয়ে গেলেন। তারপর থেকে তাঁকে আর কখনো দেখা যায়নি।
তবে শোনা যায় প্রশান্ত মহাসাগরের একটা নাম না জানা দ্বীপে থমসন সাহেব নাকি আর কয়েকজন অপঘাতে মৃত বিদেশি নাবিকদের সাথে বাস করেন।
****************
শান্তনু মুখার্জ্জী (জয়)
#SantanuStory