আ মরি বাংলা ভাষা – শান্তনু মুখার্জ্জী (জয়)

FB_IMG_1554344091782.jpg

*****************************************

Illusion বিজ্ঞাপন এজেন্সি কম দিনের মধ্যে বেশ নাম করেছে। বিশেষত শর্ট ফিল্মে তাদের জুড়ি মেলা ভার।

কিন্তু তাদের কর্ণধার Sam যার পুরো নাম সমীরণ সেনগুপ্ত একটু চিন্তিত। চিন্তার কারণ একটা বড় কন্ট্রাক্ট।

ভারত আর জার্মানির যৌথ উদ্যোগে একটা স্টিল কারখানা তৈরি হবে বর্ধমানের কাছে আর তার জন্য তৈরি হবে একটা ভিডিও ফিল্ম। তার বরাত Illision পেতে পারে যদি জার্মানি থেকে আসা থমাস ম্যাক্সোলকে খুশি করা যায়।

স্যাম কোনো ত্রুটি রাখেনি। মিটিংয়ের পর কোনো রেস্তোরাঁয় নয় বাড়িতে রাতে ডিনারের ব্যবস্থা করেছে। বউ মল্লিকার খাসা রান্নার হাত। তাতেই শেষ দানে বাজিমাত করতে চায়।

বাড়িতে এসে স্যাম সেটা জানাতেই তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলো মেয়ে ক্যামেলিয়া। বাবাকে বেশ ধমকের সুরে বললো, “Dad! Are you crazy ? জার্মান লোকটা তোমার বাড়িতে এসে মাছ ভাত খাবে? Why you didn’t consult me? I could have suggested you a food joint!”

স্যাম বললো , “আমি অলরেডি ওকে বাড়িতে বলে দিয়েছি। দেখ না। ওর খারাপ লাগবে না।”

“Do as you wish” এই বলে গোটগটিয়ে ঘরে চলে গেল ক্যামেলিয়া।

যাবার আগে আর একটা কথা সে বলে গেল যেটা মল্লিকার কানে শেলের মত এসে বিঁধলো।

ঘরে ঢোকার মুখে ক্যামেলিয়া একটু দাঁড়িয়ে, ঘাড় ঘুরিয়ে বললো, “আর একটা জিনিস তুমি ভুলে গেছ dad। You have to introduce mom। যে একটা লাইন proper english এ বলতে পারে না। It will be a face loss। তুমি মিলিয়ে নিও।”

স্যাম বললো, “আরে তোর মায়ের সাথে আলাপ না করালেই হলো।”

দরজা বন্ধ করার আগে ক্যামেলিয়া বলে গেল, “Dad , you have done a disaster। Admit that”

মল্লিকা এসে ভয়ে ভয়ে বলল, “থাক না। আমি রান্না করে দেব। ঘর থেকে নয় বেরোবনা।”

স্যাম শুধু একবার অস্বস্তিতে মাথা নাড়ল।

পরদিন সন্ধ্যেবেলা স্যাম বাড়ি ঢুকলো জার্মান ডেলিগেট থমাস ম্যাক্সোলকে নিয়ে। প্ল্যান মত মল্লিকা রান্না করে ঘরে নিজেকে বন্দি করে রেখেছে। আপ্যায়নের ভার নিয়েছে ক্যামেলিয়া।

দরজা খুলে বিলিতি কায়দায় স্বাগত জানিয়ে ক্যামেলিয়া বললো, ” So how was your day?”

মুচকি হাসল থমাস। স্যামের মুখে অস্বস্তির ছাপ। ব্যাপার কি?

ক্যামেলিয়া আবার জিগেস করলো, “How did you find Calcutta?”

স্যামের মুখে অস্বস্তি বাড়লো । কিন্তু এবার মুখ খুলল থমাস ম্যাক্সোল। ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে বললো, “no English । limited knowledge।”

ক্যামেলিয়ার চোখ কপালে। কি বলছে লোকটা?ইংলিশ জানেনা। তাহলে কীভাবে ক্যামেলিয়া কথা বলবে ? সে তো জার্মান জানে না।”

সমাধান এলো থমাসের থেকে । “আমি বাংলা জানি। তুমি বাংলা বলো।”

এবার ক্যামেলিয়ার অবাক হবার পালা।

থমাস বললো, ” আমি টেগর পড়েছি। আমি ওঁর খুব ভক্ত।”

ক্যামেলিয়া চোখ গোল গোল করে প্রশ্ন করলো , “But how? মানে কি ভাবে?”

নির্ভেজাল বাংলায় থমাস বলল, “অবাক হচ্ছো ? তাহলে শোনো। এটা গল্পের মত। আমার ঠাকুরদা পিটার থমাস ছিলেন শান্তিনিকেতনের ছাত্র। রবীন্দ্রনাথ টোগর খুব স্নেহ করতেন ওনাকে। ঠাকুরদা বিয়ে করেন কলাভবনের স্টুডেন্ট বিমলা চক্রবর্তীকে। আমার ঠাকুমা বিমলাকে টেগর খুব ভালবাসতেন । তাই ঘরে বাইরে উপন্যাসে নায়িকার নাম বিমলা রাখেন।

এরপর সেকন্ড ওয়ার্ল্ড ওয়ার শুরু হলো। ইন্ডিয়া তখন ব্রিটিশদের শাসনে। ঠাকুরদা ঠাকুমাকে নিয়ে জার্মানি চলে এলেন।

দেশে এসে টোগরের বেশ কিছু উপন্যাস আর গল্প অনুবাদ করলেন জার্মান ভাষায়। আমার বাবাকে বাংলা শেখালেন আর তারপর আমাকেও।

ঠাকুমার কাছে শিখলাম টেগরের কবিতা। তুমি জানো ‘ক্যামেলিয়া’ টেগরের একটা কবিতার নাম। তুমি পড়েছ টোগরের লেখা ?”

ক্যামেলিয়া পুরো তাজ্জব। কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না। খুব আস্তে করে স্যামকে বললো, “daddy ..call Mom”

স্যামের আমন্ত্রনে ঘরের বাঁধন ছেড়ে বাইরে এল মল্লিকা। হাত জোড় করে নমস্কার জানালো থমাস। তারপর বলল, “আমি টেগরের কবিতা বলছিলাম .. এই বলে সে মুক্ত কণ্ঠে বলে উঠলো,

“নম নম নম সুন্দরী মম জননী বঙ্গ ভূমি

গঙ্গার তীর স্নিগ্ধ সমীর জীবন জুড়ালে তুমি।”

মল্লিকা যোগ করলো

“অবারিত মাঠ গগন ললাট চুমি তব পদধূলি

ছায়া সুনিবিড় শান্তির নীড় ছোট ছোট গ্রাম গুলি।”

থমাস উচ্ছসিত হয়ে বললো “দারুণ । সত্যি দারুণ । টেগর না পড়লে জীবনকে জানা যায় না। আমি ইংলিশ জানিনা। কিন্তু তাতে আমার কোনো অনুতাপ নেই। আমি জার্মান জানি। আমার মাতৃ ভাষা । আর জানি বাংলা। আমার ঠাকুমার ভাষা তাই আমার মাতৃ ভাষার মত।”

তারপর স্যামের দিকে ঘুরে বললো, “আমি তোমায় সমীরণ বলেই ডাকবো। আর একটা উপদেশ দেব। বাড়িতে বাংলাতেই কথা বলো। ক্যামেলিয়া জানেনা যে ও কি মিস করছে। বাংলার মত এত মিষ্টি ভাষা খুব কম আছে। তোমাদের জন্য ইংরেজি বিদেশি ভাষা। সেটা না জানা অপরাধ নয়। বাংলা না জানা অপরাধ।”

ক্যামেলিয়া মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল।

ডিনার টেবিলে বসে থমাস সাজানো প্লেটের দিকে তাকিয়ে বললো, “আমি পাস্তায় নয়, পোস্ত পেলেই খুশি। ”

খাওয়া শেষে স্যাম অর্থাৎ সমীরণ একটু সংকোচ করে জিগেস করেই ফেলল অর্ডার পাবার কি সম্ভবনা।

উত্তরে থমাস বললো, “তোমার কোম্পানি খুব ভালো কাজ করে। অর্ডার পাবার মতোই কিন্তু সমস্যা একটাই। আমি ফিল্মটা বাংলায় বানাবো যেটা তুমি ভালো জানোনা। তাই ওখানেই একটু সমস্যা।”

ক্যামেলিয়া বলে উঠলো, “সমস্যা নেই। মা আছে তো। মা হেল্প মানে সাহায্য করে দেবে।”

থমাস মল্লিকার দিকে তাকিয়ে বলল, ” আপনি ভরসা দিলে আমি অর্ডারটা দিতে পারি। কি সাহায্য করবেন?”

মল্লিকা কিছু বলার আগেই সমীরণ বলে উঠলো, “হ্যাঁ করবে বৈকি। ও সাহায্য না করলে আমি জীবনে কিছুই করতে পারতাম না।”

থমাস বেরিয়ে গাড়িতে ওঠার আগে বললো, “কাল ওয়ার্ক অর্ডার দিয়ে দেব।”

রাত বারোটা। ঘরে ঢুকে সমীরণ আর ক্যামেলিয়া অপরাধীর মত তাকালো মল্লিকার দিকে। মল্লিকা ক্যালেন্ডারের তারিখ পাল্টে বললো, “আজ একুশে ফেব্রুয়ারি। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। বাংলায় কথা বলা শুরু করার জন্য আজকের থেকে ভাল দিন আর হয় না। কি রে মামনি এবার বাংলাটা গুরুত্ব দিয়ে বলবি তো?”

চোখে ভর্তি জল নিয়ে মল্লিককে জড়িয়ে ধরে ক্যামেলিয়া বলল, “বলব।”

*****************************************

#SantanuStory

গল্পটি কাল্পনিক।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *