***********************************
লালবাজারে সাইবার সেলের অফিসার গোবিন্দ চাকলাদারের আর্তনাদে সবাই ফিরে তাকালো। গোবিন্দ বাবুর চোখ ছানা বড়া। টাকের ওপর যে অবশিষ্ট গোটা দশেক চুল আছে সেগুলো দাঁড়িয়ে গেছে। সামনের ল্যাপটপে ফেসবুক খোলা।
কি হয়েছে জানতে ছুটে এলো জুনিয়র অফিসার সুনন্দ। কি হয়েছে জিগেস করাতে গোবিন্দ চাকলাদার আঙ্গুল উঁচিয়ে নির্দেশ করল তার ফেসবুক ওয়ালে। সেখানে যা লেখা আছে তা দেখে সুনন্দর পর্যন্ত ঘাম ছুটে গেল।
তরুণ উদীয়মান লেখক রামানুজ পাকড়াশি আপডেট করেছে – ” সকাল সাড়ে এগারোটায় লাইভে আসছি। আত্মহত্যা করব।”
সর্বনাশ। এযে এখুনি কিছু করতে হবে। কি হলো এমন একজন উদীয়মান লেখকের। অবসাদ? পারিবারিক অশান্তি? সন্দেহটা আগে হয়নি কেন? এই লেখকের সর্বশেষ উপন্যাসের নাম ‘আত্মহত্যা’ । না বইটা গোবিন্দ বাবু পড়েন নি। কিন্তু বইমেলায় নীলাচল প্রকাশনার বাইরে বিজ্ঞাপন দেখেছেন। বইটার প্রচ্ছদে একটা শাড়ির ফাঁস। ফ্যান থেকে ঝুলছে। সেটা তার মনে আছে।
গোবিন্দ বাবু বুঝতে পারলেন লেখকরা অনেক সময় নিজের মানসিক অবস্থা তাদের লেখার মাধ্যমে ব্যক্ত করেন।
না এত কিছু ভাবার সময় নেই। এখন এগারোটা বাজে। হাতে মাত্র আধ ঘন্টা। লোকটাকে বাঁচাতেই হবে।
রামানুজ পাকড়াশির বাড়ি গোবিন্দ বাবু চেনেন না। তাই নীলাচল প্রকাশনাতে ফোন করলেন। সেখানে নিজের পরিচয় দিতেই পাওয়া গেল বাড়ির ঠিকানা। একবার ভাবলেন ওদের বলবেন ঘটনাটা। কিন্তু তাঁর অভিজ্ঞতা তাঁকে বললো যে সেটা ঠিক হবে না। বেকার হৈ চৈ হবে। তার থেকে তিনি নীরবে যা করার করবেন।
বাইকটা বার করতে করতে ফোন করলেন পাকড়াশির পাড়ার লোকাল থানায়। সেখানে বললেন যত দ্রুত সম্ভব রামানুজের বাড়ি পৌঁছে ওকে আটকাতে।
পাকড়াশির বাড়ি লালবাজার থেকে মিনিট দশেকের পথ। ওখানে পৌঁছে গোবিন্দ বাবু দেখলেন লোকাল ওসি হাজির হয়েছেন দুটো কনস্টেবল নিয়ে। গোবিন্দ বাবু বেশ রেগে বললেন, “এত সময় লাগলো কেন আপনাদের আসতে?
ওসি গুণময় সাহা প্যান্টটা ওপরে টেনে ঠিক করতে করতে বললেন যে, “আজ্ঞে ওই কনস্টেবল দুটো দেরী করলো। আর লাশ নামাবার ব্যাপার । সেই জন্যই একটু লোক নিয়ে এলাম।”
গোবিন্দ বাবু মেজাজ হারালেন। বললেন, “লাশ কোথায়। আত্মহত্যা আটকাতে আপনাদের পাঠিয়েছি। এখানে মজা দেখতে নয়। ছাড়ুন। চলুন আমার সাথে।”
বন্ধ গেট ঠেলতেই খুলে গেল। নীচের ঘর অন্ধকার। স্যাৎস্যাতে। সিঁড়ি দিয়ে ওপরের দিকে দৌড়লেন গোবিন্দ বাবু। পেছনে দুই কনস্টেবল আর ওসি গুণময়।
দোতলায় কেউ নেই নাকি। প্রথম ঘরটা বৈঠক খানা। সেটা ফাঁকা। উল্টোদিকে কিচেন। রান্নাবান্নার কোনো চিন্হ নেই। সকাল থেকে রান্না হয়েছে বলে মনে হলো না। অবশ্য সেটাই স্বাভাবিক। আত্মহত্যা করলে সে আর খেয়ে কি করবে ?
পাশেই বেড রুমের দরজা আধ খোলা। উঁকি মারলেন গোবিন্দ বাবু । নাঃ কেউ নেই।
হঠাৎ একটা ক্যাঁচ করে আওয়াজে চমকে উঠলেন তিনি। কোনো ভারী জিনিস টানার শব্দ।
কি করবেন বুঝে উঠতে পারলেন না গোবিন্দবাবু। কি ভাবে জানবেন রামানুজ এখন কি করছে। হঠাৎ বিদ্যুতের মত মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেল। ফেসবুক খুললেন তিনি। পাকড়াশি লাইভ শুরু করেছে। একটা চেয়ার টেনে আনল সে। এই বার নিশ্চয়ই ওর ওপর উঠবে। ক্যামেরাটা আরেকটু কাত করলেই ওপরে ফানে ফাঁস দেখতে পাবেন তিনি। কিন্তু কোন ঘরে?
এবার তিনি পাকড়াশির গলা শুনলেন। মিহি গলায় উদীয়মান তরুণ লেখক রামানুজ পাকড়াশি বলছে , “আমি লাইভে এসে গেছি। আপনারা তৈরী তো। আমি শুরু করছি।”
কথাটা প্রতিধ্বনিত হলো। না প্রতিধ্বনি নয়। একটা শুনেছেন ফেসবুকে আর একটা বেডরুমের উল্টোদিকের ঘর থেকে যার দরজাটা বন্ধ।
গোবিন্দবাবু লাফিয়ে পড়লেন দরজার ওপরে। ভেতর থেকে সেটা বন্ধ। সময় নেই। গোবিন্দবাবু, দুই কনস্টেবল আর ওসি গুণময় সাহা সজোরে আঘাত করলেন দরজায়। ছিটকিনি ভেঙে দরজা খুলে গেল।
ল্যাপটপের সামনে বসে পাকড়াশি। অবাক চোখে তাকিয়ে তাদের দিকে। ঘটনার আকস্মিকতায় সে ঘাবড়ে গেছে।
কান থেকে হেডফোন খুলে সে জিগেস করল, “কি ব্যাপার? পুলিশ কেন?”
গোবিন্দবাবু সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে ফাঁস খুঁজছেন। সেখানে কিছু দেখতে না পেয়ে যেন হতাশ হলেন আর তারপর সরাসরি জিগেস করলেন পাকড়াশিকে।
-“সুইসাইড করছিলেন কেন? কি মেশানো আছে ওই গ্লাসের জলে? বিষ?”
পাকড়াশি যেন আকাশ থেকে পড়ল। সুইসাইড?
নিজেকে একটু সামলে সে বললো, “কোথাও ভুল হচ্ছে স্যার। আমি আত্মহত্যা বলে একটা বই লিখেছি শুধু। নিজে করিনি।”
-“তাহলে এটা কি?” গর্জে উঠলেন গোবিন্দ বাবু।
পাকড়াশি দেখলো গোবিন্দ বাবুর হাতের মোবাইলে তার ফেসবুক প্রোফাইল খোলা আর সেখানে লেখা – ” সকাল সাড়ে এগারোটায় লাইভে আসছি। আত্মহত্যা করব।”
মাথা চুলকে অপরাধীর মত তাকালো পাকড়াশি।
তারপর নিচু গলায় বললো, “সরি স্যার। টাইপো।”
গোবিন্দবাবু আবার গর্জে উঠলেন, “মানে? টাইপো আবার কি?”
পাকড়াশি হাত কচলাতে কচলাতে বললো, “টাইপ করতে গিয়ে ‘পড়ব’ টা ‘করব’ হয়ে গেছে। ওটা হবে আত্মহত্যা পড়ব। আমার নতুন উপন্যাসের কিছু অংশ পাঠ করবে লাইভে। আইডিয়াটা আমার পাবলিশার নীলাচল প্রকাশনীর দেয়া। কিন্তু এই একটা ছোট্ট ভুলে কি বিরাট কান্ড হয়ে গেল। আমায় ক্ষমা করবেন স্যার।”
গোবিন্দবাবু হাহা করে হাসিতে ফেটে পড়লেন। তারপর বললেন , ” এবার থেকে বানানে একটু যত্নবান হবেন। কি কান্ডটাই না ঘটিয়েছিলেন। “
তারপর যাবার আগে তাকালেন ল্যাপটপের দিকে। লাইভ তখনো চলছে। দুহাজার পাঁচশো কুড়ি জন watching। তার মানে তারা এই ঘটনা পুরো দেখেছে! গোবিন্দবাবু সেদিকে মুখ করে বললেন, “আপনারা ওর লেখা পড়বেন। ও ভালোই লেখে।” এই বলে লাইভ বন্ধ করে দিলেন।
গোবিন্দবাবু চলে যেতেই পাকড়াশি একটা ফোন পেল। নীলাচল প্রকাশনীর মালিক সুধারঞ্জন প্রামানিকের ফোন। উচ্ছসিত হয়ে বললেন,
-“কি মার্কেটিং গিমিক দিলে ভাই। আমি তো ভাবতেও পারিনি। আমি তোমায় লাইভে বই পড়ার বুদ্ধি দিয়েছিলাম আর তুমি তার ওপর পুলিশ টুলিশ নিয়ে হাজির হয়ে চমকে দিলে। ধন্যি তোমার মার্কেটিং বুদ্ধি। তোমার বইয়ের বিক্রি এবার আটকায় কে?
রামানুজ একবার ভাবলো সে বলে দেবে যে যা ঘটেছে তাতে তার কোনো পূর্ব পরিকল্পিত বুদ্ধি নেই। এটা একটা ভুল থেকে সূত্রপাত আর তারপর এই কান্ড। কিন্তু সে স্বীকারোক্তি করার আগেই ফোনের লাইন কেটে গেল।
কিংকর্তব্যবিমূঢ় গল্পকার রামানুজ পাকড়াশি টেনে আনা চেয়ারটাতে থপ করে বসে পড়ল।
*****************************************
শান্তনু মুখার্জ্জী (জয়)