Teacher’s Day Special
************************
উদয় দাশগুপ্ত ল্যাপটপের ঢাকনাটা অর্ধেক বন্ধ করে সামনে রাখা জলের গ্লাস থেকে এক নিঃশ্বাসে জলটা শেষ করে “সীতারাম” বলে হাঁক ছাড়লেন।
সীতারাম বেয়ারা এসে দাঁড়াতে উদয়বাবু চোখের চশমাটা খুলে বিরক্তি ভরে টেবিলে সেটা ছুঁড়ে ফেলে বললেন ,” শত্রুজিৎ এসেছে ?”
সীতারাম পান চিবানো লাল দাঁত বের করে বললো ,”হাঁ সাব”
উদয়বাবু প্রশ্ন করলেন , “কোথায় ?”
সীতারাম মুচকি হেসে বললো , ” বাইরেই আছেন। হামি বুলাবো ?”
উদয়বাবু এক কথায় উত্তর দিলেন , “হ্যাঁ”
শত্রুজিৎ কোম্পানির Purchase Manager। উদয়বাবু ওর বস। তলব পড়েছে শুনে সে এসে দাঁড়ালো উদয়বাবুর সামনে।
উদয়বাবু একটু চুপ করে জিগেস করলেন , “মেহেতা এন্ড কোম্পানি” আমাদের কতদিন ধরে মাল সাপ্লাই করে ?”
শত্রুজিৎ একটু ভেবে বললো , “তা দশ বছর হবে।”
উদয়বাবু ফের প্রশ্ন করলেন, “ওদের মালে কি কোনো গোলমাল ছিল ?”
উত্তর এলো , “কই না তো।”
উদয়বাবু এবার গলাটা বেশ ভারী করে বললেন , “তাহলে সুখরাম সাপ্লায়ার্স থেকে রজত দত্তকে কেন ডেকেছিল ?”
শত্রুজিৎ একটা ঢোক গিলে বলল, “মনে ওরাও ভালো মাল দেয়। ছেলেটা অনেকদিন ধরে বলছিল আপনার সাথে একটা Appointment-এর জন্য। কি নাকি ভালো অফার আছে। তাই জন্য .. তা কোথায় রজত বাবু? কথা হয়ে গেছে ? অর্ডার কনফার্মড ?”
একটু উত্তেজিত দেখালো শত্রুজিৎকে। কিন্তু সেটা চট করে সামলে আবার স্বাভাবিক গলায় জিগেস করলো , “না মানে রজত বাবু কি এসেছিলেন?”
উদয়বাবু চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন , “এসেছিল । আমি দূর করে দিয়েছি। বলে কিনা অর্ডার কনফার্ম করলে 15% আমার ! আমায় টাকার লোভে দেখাচ্ছে। ঘুষ দেবে উদয় দাশগুপ্তকে।”
শত্রুজিৎ একটু থতমত খেয়ে বললো ,”না মানে এই ইনডিস্ট্রিতে তো এটা চলে। সেই জন্যই বলেছে হয়ত। আপনি একবার ভেবে দেখতে পারতেন ।”
উদয়বাবু একটা হালকা হাসি হেসে বললেন, ” ভেবে দেখেছি। তবে এটাই ভেবেছি ওর নামে কোথায় কমপ্লেন করলে কাজ হয়। ওর চাকরি যাওয়া উচিত। আর যদি তোমার এই ঘুষ দেয়ার ব্যাপারে প্রশ্রয় থাকে তাহলে তোমার resignation mail টা এখনই পাঠিয়ে দাও।”
শত্রুজিৎ হকচকিয়ে বলে উঠলো, “না না। আমি এর কিছুই জানিনা।” আর তারপর তাত্মাহুড়ো করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
বাইরে এসে শত্রুজিৎ রজতকে ফোনে ধরল। নীচু গলায় বলল, “রজত। ব্যাপারটা পুরো বুমেরাং হয়ে গেছে। আমি ভাবতে পারিনি লোকটা এতটা মাথামোটা। সততা দেখাতে গিয়ে প্রায় কোটি টাকার অফার হাতছাড়া করল। ও শালা সারা জীবন খেটেও ও টাকা রোজগার করতে পারবেনা। মাঝখান থেকে আমার তিরিশ লাখটাও গেল। আচ্ছা শোন। আমার আরেকটা কোম্পানির Purchase ডিপার্টমেন্টে যোগাযোগ আছে। আমি ওখানে তোর অর্ডারটা করিয়ে দেব। আমায় বিশ লাখ দিস। আর আমার ভাগের দশ লাখ ওখানে একজন ম্যানেজারকে দিতে হবে। ঠিক আছে। ওই কথাই রইল।”
ফোনটা কেটে পেছনে ঘুরতেই শত্রুজিৎ চমকে উঠল। ওর ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলার ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে উদয় দাশগুপ্ত। অর্থাৎ উনি সব কথাই শুনেছেন। শত্রুজিতের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে উদয়বাবু বললেন “তুমি এই মুহূর্তে কোম্পানি ছেড়ে বেরিয়ে যাও। কাল এসে full এন্ড final settlement করে নিও।
শত্রুজিৎ হাতজোড় করে ডুকরে কেঁদে ওঠে বললো, “মাপ করে দিন স্যার। আর হবে না”
উদয়বাবু সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে নিজের কেবিনে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলেন।
পরদিন বেয়ারা খবর দিলো এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক এসেছেন উদয় বাবুর সাথে দেখা করতে। পরিচয় দিয়েছেন যে উনি শত্রুজিতের বাবা। উদয়বাবু বুঝলেন ছেলের চাকরি বাঁচাতে বাবা এসেছেন। প্রথমে ভেবেছিলেন দেখা করবেন না। তারপর কি মনে হওয়াতে ভেতরে ডাকলেন।
বৃদ্ধ ঢুকলেন উদয়বাবুর কেবিনে । পেছনে কাচুমাচু মুখ করে শত্রুজিৎ। বৃদ্ধকে দেখে চমকে গেলেন উদয়বাবু। একি! এযে অজিতবাবু। তার মাস্টারমশাই। স্কুলে অঙ্ক করতেন। চেয়ার ছেড়ে উঠে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে বসতে বললেন উদয়বাবু।
অজিতবাবু রুমাল বের করে কপালের ঘাম মুছে বললেন, “বাবা উদয় । আমি জানতাম তুমি মন্টু মানে শত্রুজিতের বস। কিন্তু ওকে বলিনি। পাছে ও তার সুবিধা নেবার চেষ্টা করে। কিন্তু আজ আসতে বাধ্য হলাম। যে গর্হিত কাজ মন্টু করেছে তা ক্ষমার অযোগ্য। কিন্তু ও আমায় বললো একবার তোমার সাথে দেখা করতে । তাই এলাম।”
উদয়বাবু বললেন, “ছি ছি স্যার। আপনি কেন কষ্ট করে এলেন। আমায় তো ডাকতে পারতেন। আমি যেতাম।”
শত্রুজিৎ মনে মনে হাসল। সে যা প্লান করেছে সেই মাফিক কথা এগোচ্ছে। সে জানে স্যার যদি উদয়বাবুকে অনুরোধ করে তাহলে চাকরিটা বেঁচে যাবে”
অজিত বাবু এবার একটু ইতস্ততঃ করে বললেন, “একটা অনুরোধ আছে। বলো রাখবে ”
শত্রুজিৎ জানে কি অনুরোধ আসবে আর তার উত্তর কি হবে। সে মনে মনে প্রমাদ গুনল।
উদয়বাবুও যেন আসন্ন অনুরোধ আঁচ করতে পেরে একটু অন্যমনস্ক হয়ে গেলেন। স্যার বললে তার ছেলের শাস্তি তুলে নিতেই হবে। একটা ঢোক গিলে উদয়বাবু বললেন , “বলুন স্যার। কি করতে পারি আপনার জন্য”
অজিত বাবু পাঞ্জাবির পকেট থেকে একটা ঘড়ি বের করলেন। পুরোনো আমলের দম দেয়া ঘড়ি। তারপর বললেন, ” এটা আমাদের বংশের খুব মূল্যবান জিনিস। এটা আমার ঠাকুরদার বাবার। উনি নায়েব ছিলেন সোনাবাটি গ্রামের জমিদারের। সৎ এবং কর্ম নিষ্ঠার জন্য এ ঘড়ি জমিদার উপহার দেন তাঁকে। সেই ঘড়ি এখন আমার কাছে। কিন্তু আমার পর এ ঘড়ির যোগ্য উত্তরাধিকারী আর কেউ নেই। কথায় বলে ছাত্র সন্তানের মত। তাই এই ঘড়িটা তুমি নাও। আমি তোমায় দিলাম। আমি আজ খুব খুশী বাবা। আমার ছেলে আমার শিক্ষা নিতে পারেনি। কিন্তু তুমি পেরেছো। ”
শত্রুজিৎ চিৎকার করে উঠলো, “বাবা ..এ তুমি কি বলছো। তুমি কি এই জন্যেই এখানে আসতে চেয়েছিলে। আমার চাকরি বাঁচাতে নয়।”
অজিত বাবু সে কোথায় বিন্দু মাত্র কর্ণপাত না করে বললেন , “বাবা উদয়। কখনো অন্যায়ের সাথে আপস করোনা। সে যেই হোক না কেন। তুমি সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছ। আচ্ছা এখন চলি।”
উদয়বাবু কি বলবেন ভেবে পেলেন না। মাস্টারমশাইয়ের দেয়া উপহার না করার স্পর্ধা তাঁর নেই। তিনি বললেন , “আমি আপনার বিশ্বাসের মর্যাদা দেবার চেষ্টা করব। আপনি দাঁড়ান আমার গাড়ি আপনাকে পৌঁছে দেবে।”
অজিত বাবু একটু হেসে বললেন ,”না বাবা। আমি বাসে চলে যাব। গাড়িতে ওঠা অভ্যেস নেই।”
তারপর শত্রুজিতের দিকে না তাকিয়েই ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। শত্রুজিৎ-ও মাথা নীচু করে চলে গেল।
টেবিলে ঘড়িটার দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে রইলেন উদয় বাবু। মনের আয়নায় স্পষ্ট দেখতে পেলেন একটা ক্লাসরুম। সেখানে একটি ছেলে পরীক্ষা দিচ্ছে।। গার্ড অঙ্ক স্যার অজিতবাবু । একটা অঙ্ক কিছুতেই হচ্ছে না। ঘাড় ঘুরিয়ে টুকতে গেল সেই কিশোর আর সাথে সাথে ধরা পড়ে গেল অজিৎবাবুর হাতে। সেদিন পরীক্ষার শেষে সেই ছেলেটিকে ডেকে অজিত বাবু বলেছিলেন , ” জীবনে আর যাই হয়ে যাক কখনো অসৎ পথ নেবেনা। সৎ পথে হারাও গৌরবের কিন্তু অসৎ পথের জয় মূল্যহীন। কারণ তা টেকে না।”
সেই কিশোর আজ কোম্পানির বড়কর্তা উদয় দাশগুপ্ত। অজিৎবাবুর সেদিনের কথা তিনি আজও ভোলেন নি। চোখের কোনটা তাঁর জলে চিক চিক করে উঠল। ঝাপসা চোখে তিনি টেবিলে রাখা কেলেন্ডারে দেখলেন আজ ৫ই সেপ্টেম্বর। শিক্ষক দিবস।
*************************
*শান্তনু মুখার্জ্জী (জয়)*
#SantanuStory