*ফণী – শান্তনু মুখার্জ্জী (জয়)*

****************************

আজ আমার জীবনে যে অভিজ্ঞতা হলো সেটা এই মুহূর্তে লিখে ফেলা প্রয়োজন। এই বিভীষিকা কাটিয়ে উঠতে হয়তো আরো বেশ কিছুদিন সময় লাগবে। ততদিনে সব ঘটনা পর্যায়ক্রমে নাও মনে থাকতে পারে।

আমার সরকারি চাকরি। বিপর্যয় মোকাবিলা দপ্তরে একজন উচ্চ শ্রেণীর কর্তা। দুদিন আগে সরকারি নির্দেশ এলো আমায় পুরী আসতে হবে। কারণ আর একজন সেখানে আসছেন। তাঁর নাম ফণী। ভয়াবহ এক ঘূর্ণিঝড়। এর জন্ম বঙ্গোপসাগরের ওপর। নামকরণে বাংলাদেশ আর গতিপথ পুরী , কটক, বালাসোর, খড়গপুর ছুঁয়ে কলকাতার পশ্চিম দিকের গা ঘেঁষে বর্ডার পেরিয়ে রাজশাহী।

এর মধ্যে পুরীর ক্ষয় ক্ষতির আশঙ্কা সবচেয়ে বেশি। ঘন্টায় একশো সত্তর কিলোমিটার বেগে ঝড় আছড়ে পড়লে কি হবে বোঝা যাচ্ছে না। পর্যটকদের ফেরত পাঠানো হয়েছে । মৎস্যজীবীদের সমুদ্রে যাওয়াতে নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছে। হোটেল বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।

আমি এসেছি বিপর্যয় মোকাবিলার কাজ নিয়ে। আমার দলের অন্যান্য লোকজন ত্রাণ শিবির নিয়ে ব্যস্ত।

আমি একটা সাইকেল রিকশায় চেপে হাতে মাইক নিয়ে সতর্ক বাণী অনাউন্স করছি। পুরীর সমুদ্র সৈকত বরাবর এগোচ্ছি। দোকানদাররা অস্থায়ী ছাউনি গুটিয়ে ফেলছে , এমন সময় চোখ আটকে গেল সমুদ্রের পাড়ে, বালির ওপর। একটা মানুষ। না। এখন তো ওখানে মানুষ থাকার কথা নয়। সাবধান বাণী শুনে সবাই ওই জায়গা থেকে সরে এসেছে।

ভালো করে দেখলাম। হ্যাঁ। একটা মানুষই বটে। একটা বুড়ি। কি করছে বুড়িটা ওখানে ? রিকশা দাঁড় করিয়ে ছুটে গেলাম। প্রচন্ড হাওয়ায় দাঁড়িয়ে থাকাই দায়। না ঝড় এখনো আসেনি। এ হাওয়া ঝড়ের রুদ্রসঙ্গীতের আলাপ মাত্র । তার আগমনী বার্তা।

বুড়িটার সামনে যেতে আরো আশ্চর্য হয়ে গেলাম। বুড়ি নাচছে। পরনে ময়লা থান। জটপড়া সাদা চুল। কোটরে ঢোকা কালি মাখা চোখ আর কিছুটা সামনের দিকে নুইয়ে পড়া চেহারা নিয়ে বুড়ি হাততালি দিয়ে নাচছে।

আমায় দেখে কোনো ভ্রূক্ষেপ পর্যন্ত করলো না। আমি ডাকলাম , “বুড়ি মা। ও বুড়ি মা”!

সে নির্বিকার। ততক্ষনে আকাশে কালো মেঘ ছেয়ে গেছে। সমুদ্র ফুঁসছে। হাওয়ার জোর যেন প্রত্যেক মুহূর্তে দ্বিগুন হচ্ছে।

আমি বুড়িকে ধরে বললাম, “এখান থেকে চলো বুড়ি মা”।

বুড়ি আমায় এক ঝটকায় সরিয়ে দিয়ে বললো, “যাবুনি। কিছুতেই যাবুনি । ফণী আসছেরে, ফণী আসছে। ফণীরে দেখব। ”

আচ্ছা পাগলের পাল্লায় পড়লাম। ঝড় দেখতে গিয়ে শেষে সমুদ্রে তলিয়ে না যায়।

আমি বললাম ,”মা, দেখার কিছু নেই। শিগগিরি চলো , এখুনি সব লন্ডভন্ড হয়ে যাবে।”

বুড়ি বললো , “লন্ডভন্ড আমার যা হবার তা হয়ে গেছে বাপ। এই বারে গোছাবার পালা। ফণী আসছে । ফণী আসছে ।”

আবার হাততালি দিয়ে ফোকলা দাঁতে খিল খিল করে হেসে উঠলো বুড়ি।

এর মধ্যে হাওয়ার গতি আরো বেড়ে গেছে। সাথে শুরু হয়েছে তুমুল বৃষ্টি। বুড়িকে জড়িয়ে ধরলাম। কোনোভাবে পাঁজা কোলা করে যদি আনা যায়।

বুড়ি নাছোড়বান্দা। সে যাবেনা। এমন সময় হঠাৎ বুড়ি চিৎকার করে উঠলো।

-“মাথা সামলে বাপ।”

চকিতে ওপরে তাকালাম আর যা দেখলাম তাতে বুকের রক্ত জল হয়ে গেল। আমার ঠিক পেছনে একটা লম্বা পাঁচ বাতির স্তম্ভ দুলতে দুলতে যেন টাল রাখতে না পেরে ধেয়ে নামছে আমায় লক্ষ্য করে।

নিজের চোখে দেখলাম আমার মৃত্যু আসন্ন । কোনদিকে গেলে বাঁচবো জানিনা। স্তম্ভের ওপর গোলাকারে লাগানো আলো। কোনো একটা মাথায় পড়বেই।

বুড়িকে কোনো ভাবে নামিয়ে গড়িয়ে দিলাম। আর তারপর চোখ বুঁজে ফেললাম।

কিন্তু না। কিছুই হলোনা। ভয়ে তখনো চোখ বন্ধ। চোখ খুললাম বুড়ির ডাকে। আর্ত কণ্ঠে বুড়ি বললো

-” বাবা ফণী এসেছিস?”

সভয়ে তাকালাম আর যা দেখলাম সেটা ভাবতেও গা শিউরে উঠছে।

একটা লম্বা লোক। খালি গা । একটা হাঁটুর ওপর ধুতি পরে এক হাতে বাতি স্তম্ভটা ধরে দাঁড়িয়ে আছে। আর সেই কারণেই স্তম্ভটা আমার মাথায় পড়েনি। লোকটার অদ্ভুত স্থির চাহুনি। ওই বিপর্যয়ের সে যেন কোনো তোয়াক্কাই করছেনা।

বুড়ি আমায় জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠলো , “ওই তো আমার ফণী। ওই তো। আয় বাবা । কতদিন তোকে দেখিনি ”

আমি তখন ভাষা হারিয়েছি। কি করে সম্ভব ? একজন মানুষ অত বড় একটা লোহার স্তম্ভকে এক হাতে ধরতে পারে? কি করে এই দুর্যোগে এমন অবিচল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে?

মাথা ঘুরে গেল। আমি ওখানেই বসে পড়লাম। এর মধ্যে দেখলাম দূর থেকে কিছু লোক আমাদের দিকে ছুটে আসছে। কিছুটা কাছে এলে বুঝলাম ওরা আমার দলের ছেলেরা। আমায় দেখতে পেয়ে আমায় আর বুড়িকে উদ্ধার করতে এসেছে।

সামনেই থানা। ওখানেই আশ্রয় পেলাম। ওই ছেলেদের মুখে শুনলাম বাতিস্তম্ভ হেলে পড়লেও সম্পুর্ন ভাবে ভেঙে পড়েনি। তাই আমার কোনো ক্ষতি হয়নি। খুব জোর রক্ষা পেয়েছি। কিন্তু কোনো অপরিচিতের উল্লেখ ওরা করলোনা। তাহলে কি আমার জীবনদাতাকে আমি আর বুড়ি ছাড়া আর কেউ দেখতে পায়নি। সব কেমন যেন গুলিয়ে যেতে লাগলো।

আমি প্রাণে বাঁচলেও বুড়ির দেহে তখন আর প্রাণ নেই। লাশ শনাক্ত করলো একজন জেলে। সে যা বললো তাতে আমার বিস্ময়ের আর সীমা রইলনা।

“বুড়ির ছেলের নামও ফণী। সেও জেলে ছিল। গতবছর মাছ ধরতে গিয়ে মাঝ সমুদ্রে ট্রলার ডুবি হয়ে মারা যায়। ছেলে ছাড়া বুড়ির আর কেউ নেই। ছেলের শোকে বুড়ি পাগল হয়ে যায়। রোজ সকালে গিয়ে সমুদ্রের পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকতো এই আশায় যে ফণী আসবে। কিন্তু ফণী যে মৃত । সে আর কি করে আসবে ? তারপর অনেকে বলতে লাগলো ফণী নাকি মাঝে মাঝে জল থেকে উঠে আসে। কোনো বিপদ দেখলে তার আগাম সংকেত দিয়ে যায়। এই শুনে বুড়ির মনে আরো আশা বেড়ে গেল। যখন তখন সমুদ্রের পাড়ে গিয়ে “ফণী ফণী” করে ডাকত। বুড়ি জানত আজ ওই ঝড়ে ওর ফণী আসবেই কাউকে না কাউকে রক্ষা করতে।

সেই ফণীর পথ চেয়েই বুড়ি মরে গেল। ”

এই অবধি বলে গামছা দিয়ে চোখ মুছলো জেলে।

থানার বড় বাবু সাদা চাদর দিয়ে বুড়ির শরীর ঢেকে দিল।

আমি এসে বারান্দায় দাঁড়ালাম। ঝোড়ো হাওয়ায় গাছগুলো দুলছে। এক কনস্টবল এসে বললো ,”স্যার ভেতরে গিয়ে বসুন। ফণী এলো বলে। কত যে প্রাণ নেবে “।

আমি মনে মনে বললাম ,”তুমি আর কি জানো ? ফণী তো এসেছিল । আর সব ফণী প্রাণ নেয় না। জীবনদানও করে।”

*******************************************

*শান্তনু মুখার্জ্জী (জয়)*

#SantanuStory

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *