**********************************
ভোটের প্রচার সেরে বাড়ি ফিরে যদুনাথ সরকার আরামকেদারায় শরীরটা এলিয়ে দিল। খুব পরিশ্রম যাচ্ছে কদিন। এই বয়সে কি আর এত ধকল সহ্য হয় ? তার সাথে এত রকমের ব্যবসা। সেগুলোতে দৃষ্টি রাখতে হয়। আর দৃষ্টি রাখতে হয় সুনির্মালের ওপর। নিজের লোক যে এত বেইমান হতে পারে তা সুনির্মালকে না দেখলে সে বুঝতে পারতো না।
সুনির্মল যদুনাথের দলেই আগে কাজ করতো । খুব চটপটে আর বুদ্ধিমান। পাশের গ্রামের ছেলে। বলতে গেলে যদুনাথের ডান হাত ছিল সুনির্মল।
সুনির্মল অত্যন্ত সৎ আর নির্ভীক। তার প্রভু অন্ত প্রাণ ছিল। এই কর্তব্য নিষ্ঠা দেখে যদুনাথ সুনির্মলকে তার ব্যবসাতে কাজে লাগলো। আর সেখানেই সে মোক্ষম ভুল করে বসলো।
যদুনাথের পয়সা রোজগারের দিকটা খুব স্বচ্ছ ছিল না। তার ছিল অনেক জাল কারবার।
ব্যবসার এই নোংরা দিকটা সুনির্মালের জানা ছিলোনা। সে প্রতিবাদ করে এবং শেষে সে ব্যবসা থেকে ইস্তফা দিয়ে আবার তার গ্রামে ফিরে যায়। অনেকবার ভেবেছে পুলিশে জানিয়ে দেবে কিন্তু এককালের মনিবের প্রতি আনুগত্য তাকে চুপ করিয়ে রেখেছে।
কিন্তু আর নয়। সে জানে যদুনাথ যদি এবারও জিতে MP হয় তাহলে তার দাঁত নখ আরো বেরিয়ে আসবে আর তার অপরাধের কোনো সীমা থাকবেনা। তাই সে প্রকাশ্যেই বিরোধিতায় নেমেছে। যদুনাথ মুখে বলছে বটে যে তার কিছু যায় আসেনা কিন্তু সে বেশ বিচলিত।
আরামকেদারায় শুয়ে যদুনাথ আজকের ঘটনাটা মনে করলো। রথতলার মাঠে বিরাট জনসভা। বক্তৃতা দিচ্ছে নির্দল প্রাথী যদুনাথ। এমন সময় সুনির্মল একটা ষোলো সতেরো বছরের মেয়েকে নিয়ে সেখানে ঢুকে পড়লো। যদুকে দেখিয়ে মেয়েটাকে জিগেস করলো ,”এই সেই লোক?”
মেয়েটি বললো ,”হ্যাঁ । ইনি আমায় বেচে দিয়েছিলেন । কোনো ভাবে পালিয়েছি”
যদুনাথের সাঙ্গপাঙ্গরা ওদের তাড়িয়ে দিলো বটে কিন্তু লোকের কাছে বড় বেইজ্জত হলো যদুনাথ।
চমকে তাকালো সে। আরামকেদারার মাথায় পাখাটা বনবন করে ঘুরছে। যদুনাথ বুঝলো সুনির্মল এ ভাবে বিরোধিতা করলে তার জেতার কোনো সুযোগ নেই । অতএব রাস্তা পরিস্কার করো। জঞ্জাল সাফ করো।
যদুনাথ উঠে পড়ল । যদুর বউ বললো , “এখন আবার বেরোবে নাকি ?”
যদু ছাতাটা তুলে নিয়ে বললো , “এখুনি আসছি”
দীঘির ধারে ভাঙা মন্দির । সেখানে দালানে বসেছিলো রামদীন। বয়স হয়েছে কিন্তু চেহারা এখনো মজবুত। কষ্টি পাথরের মত গায়ের রং। মাথায় কোঁকড়া চুল। খালি গা। হাঁটুর ওপর ধুতি পরা।
যদুনাথকে দেখে সে খুব খুশী হয়েছে বলে মনে হলোনা। একটু বিরক্ত হয়েই বললো , “কি ব্যাপার বড় ঠাকুর ? আপনি এখানে?”
যদুনাথ মুচকি হেসে বললো ,”তুই তো আমায় ভুলেই গেছিস । একবার তো খবরও নিস না”
রামদীন বললো , ” আপনি নেন। আগের ভোটে আপনার জন্য বোমা ফেলতে গিয়ে পুলিশ ধরলো। আপনি ছাড়াতেও এলেন না। বউটা না খেতে পেয়ে বিনা চিকিৎসায় মরে গেল।”
যদুনাথ বললো ,”ওসব পুরোনো কথা বাদ দে। একটা কাজ করবি আমার জন্য ? পঁচিশ হাজার দেব। সঙ্গে এনেছি।”
রামদীন বললো ” ও ভোট এসেছে তাই মনে পড়লো। তবে এবার আর কিছুই করবোনা। আমি ওসব ছেড়ে দিয়েছি। আর আমার মন ভালো নেই। মেয়েটাকে কাল রাতে থেকে পাচ্ছি না। আমার সাথে ঝগড়া করে চলে গেছে।”
যদুনাথ মুখে একটা সমব্যথী ভাব এনে বললো , “আহা রে। ঝগড়া করলি কেন ?
রামদীন মুখ তেতো করে বললো , “বিয়ে করার শখ হয়েছে। আমি বললাম একটু দাঁড়া আর কয়েক বছর যাক। এই নিয়ে এ কথায় সে কথায় ঝগড়া লেগে গেল। মাথা গরম করে একটা চড় মেরে দিলাম। তারপর রেগে বেরিয়ে গেলাম। ফিরে এসে দেখি মেয়েটা ঘরে নেই! এখনো ফেরেনি মেয়ে।”
যদুনাথ নিষ্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল , ” মেয়ে ঠিক ফিরে আসবে। মেয়ের বিয়ের জন্য পঞ্চাশ হাজার দেব তোকে রামদীন”
রামদীন দৃঢ় ভাবে বললো ,”না । আপনার কোনো কাজ আমি করবোনা।”
যদুনাথ কাঁধে হাত রেখে বললো ,”1 লাখ । আর না করিস না”
রামদীন একটা ঢোক গিলে বললো ,”কাজটা কি ?”
পকেট থেকে একটা পিস্তল বের করে রামদীনের হাতে দিয়ে বললো ,”খতম করতে হবে !”
কাঁপা গলায় রামদীন বললো “কাকে?”
যদুনাথ একটা দাঁত চাপা হাসি দিয়ে বললো , “সুনির্মল। চিনিস তো। আমার কাছে কাজ করতো”
রামদীন চমকে উঠে বললো ,” খুন করতে বলছেন কর্তা ? আমার কিছু হয়ে গেলে ? মেয়েটার কথা একবার ভাববেন না ?”
যদুনাথ চলে যাবার জন্য পা বাড়িয়েছিল। ঘাড় ঘুরিয়ে বললো ,”তোর কিছু হবে না। আমি তো আছি। মেয়েটা ফিরে এলে বিয়ের ব্যবস্থা কর।
রামদীন আকুতি করে বললো ,”কিন্তু আমার তো ফাঁসি হয়ে যেতে পারে। তখন কি হবে আমার মেয়ের ?”
যদুনাথ রামদীনের হাত ধরে বললো ,”তুই চাস না তোর মেয়ে সুখী হোক। ও ভালো নেই। তুই এই কাজটা করলে ওর বিয়ে দিয়ে ওকে সুখী কর।”
সেদিন রাতে সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। যদুনাথ এসে দাঁড়ালো বাড়ির পেছনের বাগানে। কাজ শেষ করে এখানেই রামদীন আসবে বলেছে।
রাত সাড়ে বারোটা। “বড় ঠাকুর ” ডাক শুনে পেছনে ফিরে তাকালো যদুনাথ।
রামদীন এসেছে। সারা গা ঘামে ভেজা। দুটো চোখ জবা ফুলের মত লাল। হাতে একটা নারকোল কাটার দা আর সেটা চুঁইয়ে রক্ত পড়ছে।
যদুনাথ জিগেস করলো , “কাজ শেষ ? ”
রামদীন বললো “হ্যাঁ সুনির্মলকে খতম করে দিয়েছি। ”
যদুনাথ বললো , “পিস্তল দিলাম তো। দা দিয়ে মারলি কেন ?”
রামদীন বললো ,”গুলিই করেছি”
যদুনাথ অবাক হয়ে বলল ,”তাহলে ঐ কাটারিতে কার রক্ত?”
রামদীন হাঁটু মুড়ে বসে ডুকরে কেঁদে বললো ,”আমার মেয়ের । ও পালিয়ে সুনির্মলকে বিয়ে করেছিল বড় ঠাকুর। আমায় কিচ্ছু জানায়নি। ও আমায় সুনির্মলকে খুন করতে দেখে ফেলে । আমার দিকে দা নিয়ে ছুটে আসে। আমি নিজেকে বাঁচাতে ওকে ধরে ফেলি। ও আমায় চিনতে পারে। আমায় বলে বাবা তুমি আমার এত বড় ক্ষতি করলো ? তোমার মেয়ের স্বামীকে তুমি খুন করলে ? তবে একটা কথা জেনে রেখো তোমার জামাইকে মেয়ের থেকে কিছুতেই আলাদা করতে পারবেনা।
এই বলে নিজের গলায় কোপ মারলো। দুটো লাশ আমি টানতে টানতে নিয়ে এসেছি। নাও। তোমার কাজ শেষ করেছি। আমায় টাকা দাও । লাখ টাকা । তোমার সামনে ওই দুটো লাশের আমি বিয়ে দেব।”
এই অবধি বলে কাঁদতে কাঁদতে হঠাৎ অট্টহাসি করে এক দৌড়ে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল রামদীন।
যদুনাথ উদ্ভ্রান্তের মত দৌড়ে গেল বাগানের মূল ফটকের দিকে। সেখানে পড়ে আছে সদ্য মৃত দুটো টাটকা লাশ। এই অন্ধকারেও চিনতে অসুবিধা হয়না একটা সুনির্মল আর অন্যটা রামদীনের মেয়ে গুড়িয়া।
পরদিন পুলিশের কাছে সব স্বীকার করে ধরা দেয় যদুনাথ। পুলিশ নানা জেরা করেও বার করতে পারেনি যে লাশ দুটো অতো রাতে কে টেনে নিয়ে এল ।
যদুনাথ রামদীনের কথা বলেছে কিন্তু পুলিশ সেটা বিশ্বাস করিনি। সেটা মিথ্যা জবাননন্দি বলে ধরে নিয়েছে। কারণ যদুনাথের বাড়ির থেকে বেশ কিছুটা দূরে যেখানে হত্যা হয়েছে সেই সুনির্মালের বাড়ির উঠোনে আর একটা লাশ পাওয়া গেছে। সুইসাইড। লাশের পরিচয় এক কালের কুখ্যাত গুন্ডা রামদীন । পুলিশের অনুমান সে খুন দুটো করে আত্মঘাতী হয়েছে। আর তিনটে মৃত্যুই আনুমানিক একই সময় হয়েছে। রাত এগারোটা থেকে সাড়ে এগারটার মধ্যে।
**********************************
শান্তনু মুখার্জ্জী (জয়)
#SantanuStory
সব চরিত্র ও ঘটনাবলী কাল্পনিক।