গন্ডগোলের গোলাপ – শান্তনু মুখার্জ্জী (জয়)

*****************************************

অফিসের থেকে এসে সদ্য ছেড়ে রাখা স্বামীর কোট টা ঝাড়তে গিয়ে পকেট থেকে জিনিসটা পেলো নবমিতা। তেমন কিছুই মূল্যবান জিনিস নয়। একটা চেপটানো গোলাপ ফুল। স্বামী সুনন্দ এমনিতে তো ভাজা মাছ উল্টে খেতে জানেনা। কিন্তু তার পকেটে গোলাপ ? এর মানে তো অনেক কিছুই হয়। গোলাপ সুনন্দকে কে দিতে পারে ? তাও আবার লাল গোলাপ। আকাশ পাতাল ভাবতে লাগলো নবমিতা।

একটা কথা মনে পড়তে ধাঁ করে মাথাটা ঘুরে গেল নবমিতার। আজ ফেব্রুয়ারির ১৪ তারিখ। ভ্যালেন্টাইনস ডে। সকালেই সে দেখেছে ফেসবুকে । এমন দিনে স্বামীর পকেটে গোলাপ ? এ নির্ঘাত প্যাঁচালো ব্যাপার । এমন সময় আরেকটা জিনিস তার চোখে পড়লো। গোলাপের ডাটির গায়ে একটা সাদা কাগজ আর তাতে একটা লাল পেনে দিয়ে লেখা বৈশাখী।

ছেলেদের ৪০ থেকে ৫০ বছর বয়সটা খুব মারাত্মক। মিড লাইফ ক্রাইসিস একেই বলে। কিন্তু শেষে তার গোবেচারা ভালো মানুষ স্বামী সুনন্দ এই ফাঁদে পড়বে সেটা সে কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না। এর শেষ সে দেখে ছাড়বে। এই সব ভাবতে ভাবতে সে দেখল ঘরে ঢুকেছে সুনন্দ।

ফুলটাকে এক ঝটকায় লুকিয়ে ফেলল নবমিতা। হাতে ফুল দেখলে সুনন্দ ঠিক একটা না একটা গল্প বানিয়ে দেবে। সে সুযোগ সুনন্দকে নবমিতা দেবেনা। উল্টে দুঁদে গোয়েন্দার মত জেরা করে নবমিতা সুনন্দর মুখ দিয়েই সত্যিটা বের করবে। কে সে? পুরোনো বান্ধবী তো কম নেই। নাকি অফিসের কেউ ? রাগে ফুঁসতে লাগলো নবমিতা।

সুনন্দ তার স্ত্রীর হঠাৎ এই পরিবর্তন দেখে একটু ঘাবড়িয়ে গেলো। নবমিতার চন্ডালের রাগ। সেটা সে জানে। কিন্তু সে তো কিছু রাগার মত করেনি ।

দুরু দুরু বুকে সে জিগেস করল ,”কি হলো তোমার ?”

নবমিতার রাগের বারুদে ওইটুকু আগুনের দরকার ছিল। ফেটে পড়ল নবমিতা।

“কদ্দিন ? কদ্দিন এ সব চলছে? কি ভেবেছিলে ? কিছু জানতে পারবোনা ?শুনে রাখো। ধর্মের কল বাতাসে নড়ে। ওপরে একজন আছেন। সবাইকে ফাঁকি দিলেও তাঁকে দিতে পারবে না। থাকো তুমি তাকে নিয়ে। আমি চললাম।”

ঘটনার আকস্মিকতায় এতটাই চমকেছে সুনন্দ যে সে কি বলবে ভেবে পেলোনা । এইটুকু বুঝলো যে তার স্ত্রী তাকে সন্দেহ করছে । তাই একটু অনুমানের ওপর নির্ভর করেই সুনন্দ বললো ,”কি বলছো ? তুমি থাকতে আমি আর কি অন্যকারো সাথে থাকতে পারি ? আর তোমার এটা মনে হচ্ছেই বা কেন ? আমার ওপর বিশ্বাস নেই ?”

নবমিতা একটা সুটকেস টেনে তাতে নিজের জিনিসপত্র, জামা কাপড় গুছিয়ে রাখতে রাখতে বললো ,”ন্যাকামি করো না। একদম ন্যাকা সাজবে না ! যে প্রমাণ পেয়েছি তারপর আর তোমার কোনো যুক্তি চলে না। বৈশাখকে নিয়ে তুমি সুখে থাকো। আমি চলি ।”

সুনন্দ সাড়ে চোখ গোল গোল করে বললো “কে বৈশাখী ? ওই নামে একটা মেয়েকে চিনতাম কলেজে পড়ার সময়। ভালো গান গাইতে। কিন্তু তার সাথে তো কোনো যোগাযোগ ই নেই।”

নবমিতা চিৎকার করে উঠলো ,”বৈশাখিকে যখন মনে পড়েছে তখন যোগাযোগটাও মনে পড়ে যাবে। আমি থাকলে তার ব্যাঘাত হবে। আমি চললাম বাবার কাছে। তুমি বৈশাখিকে নিয়ে এসো বাড়িতে। আর লুকিয়ে দেখা করতে হবে না।”

এই কথার কোনো উত্তরের সুযোগ না দিয়ে নবমিতা বেরিয়ে গেল।

নবমিতার বাপের বাড়ি। বসার ঘরে বসে নবমিতার মা আর বাবা নির্মল বাবু। নবমিতা কেঁদেই চলেছে। এইটুকু সে বলেছে যে সুনন্দ অন্য একটি মেয়ের পাল্লায় পড়েছে। তার প্রমাণ সে পেয়েছে। কি প্রমাণ এখনো বলা হয়নি কারণ মেয়ের সাথে মেয়ের মাও কেঁদে চলেছেন।

বাবা নির্মলবাবু গম্ভীর মুখে পায়চারি করতে করতে বললেন ,”তুই ডিভোর্স দিয়ে দে। বাকি দ্বায়িত্ব আমার। আজই উকিলবাবুকে ডাকছি ।”

নবমিতা বললো, “সেই ভালো। তুমি আজই ব্যবস্থা করো।”

নির্মলবাবু আক্ষেপে মাথা নাড়িয়ে বললেন ,”ঈশ ! আমি মানুষ চিনতে ভুল করলাম ? এই তো কাল সন্ধ্যেবেলা সুনন্দ এসেছিল। আমার শরীর খারাপ শুনে দেখা করতে। কি সুন্দর কথা বলে গেল। যেন আমার নিজের ছেলে। কিছুই বুঝতে পারলামনা। ওঠার সময় ওকে আমার বাগানের একটা গোলাপ দিলাম। তোকে দেবার জন্য। কোটের পকেটে রেখে ও বললো বাড়ি গিয়ে সাজিয়ে রাখবে । তা হ্যাঁ রে মা তোকে দিয়েছিল গোলাপটা ?”

নবমিতা ততক্ষনে উঠে দাঁড়িয়েছে। চোখের জল মুছে জিগেস করলো ,”গোলাপ তুমি দিয়েছিলে ?”

নির্মল বাবু বললেন ,”হ্যাঁ । আমি দিয়েছিলাম। “

নবমিতার আবার প্রশ্ন ছুটে এলো ,”বৈশাখী কে? গোলাপের গায়ে লেখা ছিল ।”

নির্মলবাবু হেসে বললেন ,”আরে ওটা আমার গোলাপ গাছের নাম। গাছ গুলোর নাম করে ফুলে লেবেলিং করছি। পরে বোঝা যায় কোন গাছের ফুল। আমার গোলাপ গাছ-ই প্রায় দশ রকমের আছে। একটার নাম বৈশাখী, একটার নাম সুনীতা, একটার নাম নিশিকন্যা , একটার নাম ..”

থামতে হলো নির্মল বাবুকে। দরজায় বেল বেজেছে। ঘরে ঢুকলো সুনন্দ। নির্মলবাবু গলা চড়িয়ে বললেন, “একি তুমি ?”

কিন্তু তারপর কিছু বলার আগেই দেখলেন মেয়ে নবমিতা সুটকেসটা তুলে তার বাবার দিকে ক্রুদ্ধ দৃষ্টি হেনে বললো ,”এ সবের জন্য তুমি দায়ী।”

এইটুকু বলে সুনন্দর হাত ধরে বললো,” বাড়ি চলো।”

নির্মল বাবু মেয়ের এই হঠাৎ মুড পরিবর্তনে হকচকিয়ে গেলেন। আঁচলের খুঁট দিয়ে চোখ মুছে নবমিতার মাও কিছু বলতে যাচ্ছিলেন কিন্তু তার আগেই সুনন্দকে নিয়ে ঝড়ের বেগে বেরিয়ে গেল নবমিতা।

গাড়িতে উঠে সুনন্দ বলল ,”তুমি গোলাপটা ফেলে এসেছিলে। ওটার গায়ে বৈশাখী নাম দেখে তোমার রাগের কারণ বুঝলাম। তারপর এখানে এলাম তোমার ভুল ভাঙাতে।”

নবমিতা সুনন্দর কাঁধে মাথা রেখে একটু অদূরে গলায় বলল , “সরি”।

সুনন্দ মুচকি হেসে পকেট থেকে সেই শুকনো গোলাপটা নবমিতার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো ,”হ্যাপি ভ্যালেন্টাইনস ডে”

******************************************

– শান্তনু মুখার্জ্জী (জয়)

#SantanuStory

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *