ত্বাষ্ট্র – শান্তনু মুখার্জ্জী (জয়)

******************************

img_4892-5.jpgদিল্লি থেকে সন্ধ্যের ট্রেন নিয়ে যখন কুরুক্ষেত্র স্টেশনে নামলাম তখন রাত পৌনে দশটা। এমন কিছু রাত নয়। কিন্তু এখানে স্টেশন জনমানব শূন্য। সেটা সম্ভবত শীতের জন্য । মোবাইলে দেখাচ্ছে দু ডিগ্রি । ঘন কুয়াশার চাদরে ঢেকে আছে চারদিক। আমার সাথে আর একজন নেমেছেন স্টেশনে । ইনিও বাঙালি। ট্রেনে দেশ পত্রিকা পড়তে দেখেছি। এদিক ওদিক দেখে সেই ভদ্রলোককেই জিগেস করে বসলাম , ” কুলি টুলি কিছু দেখতে পাচ্ছেন নাকি ?”

ভদ্রলোক একটা হালকা হাসি দিয়ে বললেন ,”এই রাতে কুলি পাবেননা। আমার ড্রাইভার আসছে এখুনি। আপত্তি না থাকলে আমার সঙ্গে চলুন। আমি আপনাকে নামিয়ে দেব।”

এত মেঘ না চাইতেই জল। অন্যসময় হলে “ছিঃ ছিঃ কি দরকার ” টাইপের ভদ্রতা করতাম কিন্তু এই পরিস্থিতিতে আমি একবারেই প্রস্তাব লুফে নিলাম।

স্টেশনের বাইরে এসে দেখলাম একটা কালো এস ইউ ভি গাড়ি দাঁড়িয়ে। সেটায় উঠে ভদ্রলোক আমাকেও উঠতে বললেন।

রাতের অন্ধকার ভেদ করে ছুটতে লাগলো গাড়ি। এটা ভাড়া গাড়ি। এতক্ষন কেউই কারো নাম জিগেস করিনি। ভদ্রলোক খুব কম কথা বলেন। মাথার ওপর চশমা তুলে মোবাইলে কিছু টাইপ করে চলেছেন। শেষে নীরবতা ভেঙে আমিই প্রশ্নটা করলাম।

– “আপনি কি এখানে বেড়াতে না কাজে ?”

টাইপ থামিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে ভদ্রলোক বললেন , “ব্যবসার কাজে বলতে পারেন !”

আমি একটা ভদ্রতার হাসি হেসে বললাম , “আচ্ছা। আমি অবশ্য বেড়াতে এসেছি। একা একা ঘুরতে বেশ লাগে ”

ভদ্রলোক এবার একটা ব্যঙ্গাত্মক হাসি দিয়ে বললেন , “আমি জানি আপনি কেন এখানে এসেছেন । তাই আমাকে অকারণে মিথ্যে বলার প্রয়োজন নেই। ভুঁইয়া বাবার সাথে আমিও দেখা করবো। আপনি একা নন। আপনাকে এই শীতে লিফট দিলাম। প্রতিদানে এইটুকু তো আপনি করবেন আমার জন্য।'”

আমার বুকটা ধড়াস করে উঠলো। এতো কারো জানার কথা নয়। আমি এসেছি একটা গোপন মিশনে। ভারত সরকারের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ থেকে আমায় পাঠিয়েছে এখানে। কিছুদিন আগে এই অঞ্চলে এক সাধুকে নিয়ে একটা গুজব ছড়ায়। সাধুর নাম ভুঁইয়া বাবা। তিনি নাকি মাটি খুঁড়ে গর্ত করে তার মধ্যে ঢুকে তপস্যা করেন। এরকমই এক জায়গায় মাটি খোঁড়ার সময় কিছু অস্ত্র পান। মূলত তির , বল্লম আর ধনুকের অংশ। সাধু বাবা দাবি করেছেন যে সেগুলো রামায়ণ ও মহাভারতের সময়কার ব্যবহার করা অস্ত্র। সেটা নিয়ে মানুষের কৌতূহলের সীমা নেই। আমি জানি এটা নিছক গুজব বা ধাপ্পা। তাও নিশ্চিত হবার জন্য আমার এখানে আসা। কিন্তু সেটা তো গোপনে ঠিক হয়েছিল। এই ভদ্রলোক জানলেন কিভাবে ?

আমি যতটা সম্ভব নিজেকে স্বাভাবিক করে বললাম, “কি বলছেন আমি তো কিছুই বুঝতে পারছিনা। কে ভুঁইয়া বাবা ?”

ভদ্রলোক একটা সিগারেট ধরিয়ে প্রায় আমার মুখে ধোঁয়া ছেড়ে বললেন , “সোমনাথ বাবু। আপনার অভিনয় করার কোনো প্রয়োজন নেই। আপনি এখন আমার হাতে বন্দী। ওই অস্ত্রগুলো আমার চাই।আপনি শুধু অস্ত্র দেখে বলবেন যে সেগুলো জেনুইন কিনা। আর যদি আপনি বেশি ওপর চালাকি করার চেষ্টা করেন তাহলে এই বন্দুকের একটা গুলি আমায় খরচ করতে হবে। তারপর এই তেপান্তরে আপনার বডিটা পুঁতে রাখলে কেউ আর তার হদিস পাবেনা। ” চোখের পলকে দেখলাম ভদ্রলোকের বাঁ হাতে একটা রিভলবার আর সেটা আমার দিকেই তাগ করা।

এবার বুঝলাম আমি যার পাল্লায় পড়েছি তিনি একজন স্মাগলার। সম্ভবতঃ arms smuggle করেন। লোকটার নাম জানিনা। ড্রাইভার ওকে বার কয়েক চিফ বলে ডেকেছিল। আমার মনে একটা সন্দেহ দানা বাঁধেছিলো। শিবরাজ শর্মা । এই নামটা আমি বেশ কয়েকবার শুনেছি। এর সন্ধান সারা ভারতের পুলিশ করছে। কলকাতা এর ডেরা। ঝরঝরে বাংলা বলতে পারে, পড়তে পারে আর লিখতে পারে । তবে কি ….?

ধাঁ করে বলে বসলাম ,”আমি কিন্তু তোমায় চিনে ফেলেছি শিবরাজ । আমায় মেরে তুমি বাঁচতে পারবে না। ”

লোকটা এবার হেসে বললো ,”আপনার বুদ্ধির তারিফ করতে হয়। একদম ঠিক চিনেছেন। আমিই শিবরাজ শর্মা। আর এটাও নিশ্চয়ই বুঝে গেছেন যে আপনার আর পালাবার পথ নেই। ওই অস্ত্র গুলো আমার হাতে তুলে দিয়ে তবে আপনার মুক্তি। ”

আমি বললাম কিন্তু এখন সে অস্ত্র আমার কাছে কোথায় ? কাল দেখা যাবে। আমায় এখন হোটেলে নামিয়ে দিন। ”

শিবরাজ তার চোয়াল শক্ত করে বললো ,”অত কাঁচা কাজ করলে কি আর স্মাগলিং করা যায়? আমাদের কাজে একটা জিনিসের বড় অভাব। আর সেটা হলো সময়। আমরা এখুনি যাবো ভুঁইয়া বাবার ডেরায়। ড্রাইভার ইদ্রিসকে সব ইন্সট্রাকশন দেয়া আছে। ”

গাড়িটা এবার একটা প্রবল ঝাঁকুনি দিয়ে রাস্তা থেকে নেমে ঢুকলো একটা জঙ্গলে। নিশ্ছিদ্র অন্ধকার আর অবিরাম ঝিঝির ডাক ভেদ করে গাড়ি ছুটছে। কি ভুলটাই না করেছি ভাবতে ভাবতে গাড়িটা এসে থামালো একটা হোগলা পাতা দিয়ে ঘেরা অস্থায়ী ছাউনির সামনে।

শিবরাজ নেমে আমায় নামতে বললো। আমার সামনে ইদ্রিস আর পেছনে শিবরাজ। ঘড়ি বলছে রাত সাড়ে বারোটা। দরজা ঠেলতেই সেটা খুলে গেল। একটা তক্তপোষ পাতা। আর তার ওপর হাতে ভর দিয়ে আধশোয়া হয়ে রয়েছেন এক বৃদ্ধ সাধু। বুঝলাম ইনিই ভুঁইয়া বাবা।

আমাদের দেখে সাধুবাবা উঠে বসলেন। তার ঘন জটা আর দাড়ির ফাঁকে দেখলাম ভ্রু গুলো কুঁচকে গেছে। স্বভাবতই উনি এই সময় অবাঞ্ছিত অতিথি সমাগম পছন্দ করেছেন না। সেটা তার বিরক্তি ভরা চাহুনিতে স্পষ্ট।

আমি হাতজোড় করে নমস্কার করলাম। শিবরাজের অবশ্য সে সব কোনো বালাই নেই।

সাধু হিন্দিতে বললেন “এই রাতে এখানে কি ব্যাপার ? কে আপনারা ?”

শিবরাজ হিন্দিতেই উত্তর দিলো। মাথার ক্যাপটা খুলে সে বললো , ” আমি আপনার বন্ধু । আমায় দুশমন ভাববেন না। আপনি কি অস্ত্র পেয়েছেন সেটা দেখেই চলে যাব। ”

সাধুবাবা বললেন , “কাল সকালে আসুন। এখন আমার বিশ্রামের সময়।”

শিবরাজ এবার পকেট থেকে সেই রিভালবারটা বের করে সেটার মুখ উঁচিয়ে ধরলো সাধুবাবার দিকে। আমি এই সুযোগে পেছন থেকে লাফিয়ে পড়লাম শিবরাজের ওপর। কিন্তু আমি কিছু করার আগেই একটা প্রবল ঘুষি আমায় ছিটকে ফেললো। ইদ্রিস। কি জোর ওর হাতে। আমি তখন সাধুবাবার পায়ের কাছে পড়ে আছি।

শিবরাজ বন্দুক দিয়ে ইশারা করে আমায় উঠতে বললো। আমি সাধুবাবার পাশে দাঁড়ালাম। শিবরাজ বললো , “গভর্নমেন্ট যখন আপনাকে পাঠিয়েছে তখন আপনার লাশ খুঁজে বের করে সৎকারের দ্বায়িত্ব নিশ্চয়ই ওরাই নেবে। ”

হঠাৎ শিবরাজের চোখ পড়ল একটা চটের ঝোলার দিকে। সেটা ঘরের কোনায় রাখা। ওর মধ্যে থেকে উঁকি মারছে মরচে ধরা কিছু বর্শার ফলা।

শিবরাজ মুচকি হেসে বললো ,”বাঃ। দরকার ছিল সেটা পেয়ে গেছি। এবার আপনাদের দুজনকে আমার আর প্রয়োজন নেই। এই জঙ্গলে দুটো গুলি খরচা করলে কেউ জানতেই পারবেনা। রেডি হন । আমার বন্দুকের গুলির আওয়াজ খুব মিষ্টি ।

শিবরাজ বিন্দুকের সেফটি ক্যাপ টা খুলে ট্রিগারে আঙ্গুল রাখল । আমার বুকের রক্ত জল হয়ে গেছে। আর মাত্র কয়েক সেকেন্ডের অপেক্ষা। তাকালাম সাধুর দিকে । তিনি একই রকম নির্লিপ্ত। তবে এখন তার হাত আর খালি নেই। সেখানে উঠে এসেছে একটা লম্বাটে রকমের মরচে ধরা জিনিস।

শিবরাজ হেসে বললো ,”ওটা কি অস্ত্র বাবা। তুমি ওটা ছুঁড়ে আমায় মারবে ? আচ্ছা মারো। তুমি আমায় নয় আগে মারো। ”

সন্ন্যাসী আর বিন্দু মাত্র সময় নষ্ট না করে সেটা ছুঁড়ে দিলেন শিবরাজের দিকে। লম্বাটে জিনিস টা তিনটে পাক খেয়ে শিবরাজের গায়ে লেগে পড়ে গেলো। মনে হলোনা একটা আঁচর পর্য্যন্ত লেগেছে।

কিন্তু এর পর যেটা ঘটলো তার জন্য আমরা কেউই প্রস্তুত ছিলাম না। শিবরাজের বন্দুকের নল আর আমাদের দিকে তাগ করা নেই । সেটা সে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিয়েছে। তার চোখের দৃষ্টি ঘোলাটে। আর কিছু বুঝে ওঠার আগেই বন্দুকের গুলি চলল। নিজের হাতে , নিজের বন্দুক দিয়ে নিজেকে মারলো শিবরাজ । তার নিথর দেহ টা ধপ করে মাটিতে পড়ে গেলো।

সাধুবাবা কি ভেল্কি জানে ? কি ছিল ওই লম্বাটে অস্ত্রটা। হঠাৎ বিদ্যুতের মত মাথা খেলে গেল।

ত্বাষ্ট্র । হ্যাঁ মনে পড়েছে। মহাভারতে এই অস্ত্রের উল্লেখ আছে। নাম ত্বাষ্ট্র । এই অস্ত্র যার দিকে ছোঁড়া হয় তার মাথা গুলিয়ে সে নিজে নিজেকে আক্রমণ করে। তার মনে গুজব নয়। সত্যি। সত্যি সাধুবাবার কাছে মহাভারতের যুগের অস্ত্র আছে। আর তার গুনাবলী অক্ষত। বিশ্ববাজারে এর দাম কল্পনাও করা যায়না আর শিবরাজ সেই লোভেই এসেছিল। এর মধ্যে ঘটল আর এক ঘটনা।

ড্রাইভার ইদ্রিস অস্ত্র ভর্তি ব্যাগটা তুলে এক লাফে বাইরে গিয়ে উঠে বসল গাড়িতে।

সাধুবাবা চিৎকার করলেন ,”উসকো রোকো”।

যতক্ষণে আমি আর ভূইঁয়া বাবা বেরোলাম ততক্ষনে ইদ্রিস গাড়ি স্টার্ট করে অন্ধকারে মিলিয়ে গেছে।

এবার দেখলাম আর এক ভেল্কি। সাধুবাবা তাঁর বাম হাতের অস্তিন থেকে বের করলেন আর একটা অস্ত্র। এটা লম্বা হলেও মাথায় একটা গোল চাকতি। জঙ্গলের নিস্তব্ধতা খান খান করে তখন শোনা যাচ্ছে গাড়ির শব্দ। সেটা ক্রমশ মিলিয়ে যাচ্ছে। যেদিকে শব্দ আসছিল সেদিকে সাধু বাবা অস্ত্র ছুঁড়লেন। আর তারপরেই একটা বিস্ফোরণের শব্দে জঙ্গল কেঁপে উঠলো। দেখলাম একটা আগুনের পিন্ড কিছু দূরে লাফিয়ে ওপরে উঠলো আর সেই আগুনের মধ্যে একটা ঝলসানো এস ইউ ভি গাড়ি যেটা ওপরে উঠে আছড়ে পড়লো নীচে।

শব্দভেদী। এই অস্ত্রও আমি চিনি। দশরথ এই অস্ত্র দিয়েই মুনির ছেলেকে হরিন ভেবে মেরে ছিলেন। গাড়িতে বাকি অস্ত্র থাকায় বিস্ফোরণের তীব্রতা মারাত্মক ছিল। ইদ্রিসের বেঁচে থাকার কোনো সম্ভবনা নেই।

সাধুকে নিজের পরিচয় দিলাম। আসার কারণটাও বললাম আর কি ভাবে শিবরাজের খপ্পরে পড়ে ছিলাম তাও জানালাম।

সব শুনে সাধু বললেন ,”অস্ত্র গুলো মহাভারতের যুগেরই ছিল। আমি এক এক করে সবকটাই দেখছিলাম। আজ ত্বাষ্ট্র আর শব্দ ভেদী দেখছিলাম বলে ওই দুটো ঝোলার বাইরে আমার কাছেই ছিল। আমি আপনাকে সবই দিয়ে দিতাম। কিন্তু আর কোনো অস্ত্র নেই। সব কটাই ওই গাড়ির সাথে ধ্বংস হয়ে গেছে।”

আমি আফসোস করে বললাম ,” ঈশ। এমন একটা প্রাচীন আশ্চর্য্য এভাবে নষ্ট হয়ে গেল ?”

সাধু বাবা বললেন ,”ভালোই হয়েছে। এই সব অস্ত্র এখনকার অস্ত্রের চেয়েও উন্নত। এগুলো ভুল হাতে পড়লে লাভের থেকে ক্ষতি হত বেশি। তার চেয়ে এগুলো বইতেই থাক। অনেক রাত হলো। আজ আপনি আমার আশ্রমেই থেকে যান। কাল আপনাকে আমি স্টেশনে এগিয়ে দিয়ে আসবো।”

**********

শান্তনু মুখার্জ্জী (জয়)

#SantanuStory

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *