নাক ফুলিয়ে ঘৎ ঘৎ করে একটা বিশ্রী রকম শব্দ বের করে নদু হালদার বলে উঠলো , “তোমরা শ্যমলালকে কবি বলো ? ওগুলো কবিতা ? মানে নেই ! অন্ত মিল নেই । দুর্বোধ্য কিছু শব্দের জটলা ছাড়া ওগুলো কিছুই না ।”
গুরুপদ বললো ,”সে তুমি যাই বলোনা কেন বাপু, ওর লেখা কাগজে বেরোয়। বইমেলায় বই বেরুচ্ছে শুনলাম। নিশ্চয়ই ও লেখার দম আছে। আমরা মুখ্যু তাই বুঝিনা।”
নদু হালদার খ্যাক করে উঠে বললো ,”ও লেখা আমিও লিখতে পারি। শ্যমলাল লিখুক দেখি আমার মতো ছন্দ মিলিয়ে।
যৌবন অঙ্গে ,
তটিনীর রঙ্গে,
কে গো তুমি সুন্দরী কন্যা –
আঁখিতে যে পদ্ম,
ফুটিয়েছে সদ্য,
রূপে তার জোছনার বন্যা ।।
এই লেখা আমি ইস্কুলে থাকতে লিখেছিলাম। বাংলা স্যার কান মুলে দিয়েছিলেন প্রথমটায় পরে অবশ্যি ডেকে বলেছিলেন ,”লেখাটা চালিয়ে যা। তোর হাত আছে। তখন কোথায় শ্যমলাল? এখন সে কবি হয়েছে।
কথাগুলো হচ্ছিল গোবরডাঙ্গা যুব সমিতির ক্লাব ঘরে বসে। নদু হালদারের কবি হিসেবে গ্রামে খ্যাতি থাকলেও তার লেখা কোন পত্রিকা ছাপায় নি। একটাই কারণ আর সেটা হলো লেখার ভাষা। বড্ড সেকেলে। এই যুগে এ ভাষা অচল।
শ্যমলাল কাগজের অফিসে চাকরি পেয়ে আধুনিক বাংলা ভাষাটা ভালো রপ্ত করেছিল। তার সাথে এখন সে আধুনিক যুগের কবি তকমা পেয়েছে। সব যে সে খুব ভেবে লেখে তা নয়। অনেক লেখার মানে বিদগ্ধ পাঠকেরা বের করে অনুমান করে নেয় যে কবির মনে এরকমই কোনো অন্তর্নিহীত অর্থ আছে। সামনে বইমেলা। ভটুই প্রকাশনী তার কবিতার বই বের করছে। অবশ্য শ্যমলাল নিজেই সেই বই প্রকাশের পুরো খরচা বহন করছে । কিন্তু সেটা গোপনে।
শ্যমলাল দরজার বাইরে থেকে সব শুনলো। তারপর ভেতরে ঢুকে সোজা নদু হালদারকে বললো , “নদু। হিংসে করেই গেলে। ক্ষমতা থাকে তো এমন একটা লিখে দেখাও যেটা পত্রিকা ছাপবে। লোকে আলোচনা করবে। তবে বুঝি। আসলে কি জানো। তুমি হলে অশিক্ষিত। তোমার থেকে এর চেয়ে বেশি কিছু আশা করা চলে না। তুমি থাকো ওই চপল নয়ন আর যৌবন নিয়ে। ”
নদু বললো ,”তোমার মত মাথা মুণ্ডুহীন কবিতা চাইলে এখুনি লিখতে পারি।”
শ্যমলাল বললো, “এখুনি লিখতে হবে না। কাল আড্ডায় লিখে এনো। আমি এখন চলি। পরশু বই মেলায় একটা আলোচনা চক্র আছে। পারলে সবাই এস। আমার কবিতা নিয়ে কিছু কথাবার্তা হবে।”
পরদিন আড্ডায় শ্যমলাল আগেই হাজির। একটুপরে বাকিরা এলো আর সব শেষে এলো নদু। শ্যমলাল বললো, “কি হে নদু। পারলে লিখতে ? আধুনিক কবিতা ?”
নদু মাথা নাড়িয়ে জানালো “হ্যাঁ।”
শ্যমলাল বললো ,”তাহলে আর দেরি কেন ? শোনাও ।”
নদু পকেট থেকে একটা কাগজ বের করে দুবার গলা খাঁকরে শুরু করলো –
“আকাশের গায়ে টিকটিকি উঁকি মারে,
মুগের ডাল থেকে ঝরছে সাপের বিষ
ফাগুনের সকালে কন্ডাক্টর কোকিল
ছাদের কার্নিশে বসে ডাকছে “সন্তোষপুর সন্তোষপুর
হোলি খেলে বাড়ি ফেরে বিবেকের জিরাফ
কান্নার জল ভেজা শুকনো বালি
মগজের তালশাঁসে ছিপ ফেলে বক
ঘড়ির কাঁটায় লেগে শুকনো আবেগ।”
এই অবধি বলেছে। হঠাৎ শ্যমলাল থাম থাম করে চিৎকার করে উঠলো। অন্যরা পেটে হাত দিয়ে মাটিতে শুয়ে লুটোপুটি খেয়ে হাসছে। এক শ্যমলাল গম্ভীর। সে রেগে বললো ,”এটা ক ইয়ার্কি মারছিস ? এ লেখার মনে কি ? এই সব নিম্নমানের লেখাকে পাঠকরা ছুঁড়ে ফেলে দেবে। এই বলে দিলাম। কাকে কবিতা বলে যদি জানতে চাস তো কাল বইমেলায় আসিস। আমার কবিতা পাঠ হবে।”
পরেরদিন নদু আর দলবল হাজির হলো বইমেলায়। মুক্ত মঞ্চে শ্যমলালের কবিতা পাঠ করবে বাচিক শিল্পী রঙ্গিনী সেন। একটু পরে তার অনুষ্ঠান। নদু দেখলো পর্দা ফেলা একটা ঘরে সে আয়নার দিকে তাকিয়ে চুল সেট করছে।
যথা সময়ে অনুষ্ঠান শুরু হলো। মঞ্চে চেয়ারে বসে কবি শ্যমলাল। মাইকে রঙ্গিনী। মুচকি হেসে সে শুরু করলো।
“সবাইকে শুভেচ্ছা জানিয়ে আমি অনুষ্ঠান শুরু করছি । আমি কবি শ্যমলাল নস্করের লেখা একটি কবিতা পাঠ করবো। ”
শ্যমলাল শ্রোতাদের উদ্যেশে হাত নাড়লো।
রঙ্গিনী শুরু করলো –
“আকাশের গায়ে টিকটিকি উঁকি মারে,
মুগের ডাল থেকে ঝরছে সাপের বিষ
ফাগুনের সকালে কন্ডাক্টর কোকিল
ছাদের কার্নিশে বসে ডাকছে “সন্তোষপুর সন্তোষপুর
হোলি খেলে বাড়ি ফেরে বিবেকের জিরাফ
কান্নার জল ভেজা শুকনো বালি
মগজের তালশাঁসে ছিপ ফেলে বক
ঘড়ির কাঁটায় লেগে শুকনো আবেগ।”
লাফিয়ে উঠলো শ্যমলাল। আরে এটা তো সেই কবিতা যেটা কাল নদু হালদার বলেছিল। সেই বিচ্ছিরি , অসহ্য বাজে কবিতা। সেই জঘন্য কদর্য লেখা। এ কবিতা রঙ্গিনী কি করে পেলো ? কবি হিসেবে তার নাম ডুবে গেল।
ঠিক এই সময় মঞ্চে উঠে এলেন এক ব্যক্তি। ময়লা পাজামা আর ফতুয়া পরা। কাঁধে ঝোলা ব্যাগ আর মুখ ভর্তি না কাটা অগোছালো দাড়ি। সবার সামনে তিনি শ্যমলালকে জড়িয়ে ধরলেন। পিঠ চাপড়ে বাহবা দিলেন। তারপর মাইক টেনে বললেন ,”এ লেখার কোনো তুলনা নেই। কি ভাষা। এ ভাষা সময়ের চেয়ে এগিয়ে। এ আধুনিক কবিতা নয়। এ অত্যাধুনিক কবিতা। আমি নরোহরি পাকরাশী। সাহিত্য সমালোচক। কাল প্রভাত সংবাদ পত্রিকায় আমি এই কবিতার প্রশংসা বাণী লিখবো। শুধু কবিকে অনুরোধ তিনি যেন এর মানেটা বুঝিয়ে দেন। “
শ্যমলাল পড়লো মহা বিপদে। এ কবিতা তার লেখা নয়। কি করে সে মানে বলবে ? এদিকে সে বলতেও পারছেনা এটা নদু হালদারের লেখা। সবাই জেনে গেছে এটা তার লেখা। সে দেখল নদু মিচি মিচি হাসছে। শ্যমলাল শুনলো শ্রোতারা চিৎকার করছে। “একটু বিশ্লেষণ করে দিন। “
নরোহরি পাকরাশী মুগ্ধ নয়নে তার দিকে তাকিয়ে আছে বিশ্লেষণ শোনার আশায় ।
একটাই উপায়। স্টেজে ধপ করে পড়ে অজ্ঞান হয়ে গেল শ্যমলাল। না ঠিক অজ্ঞান নয়। সেটা তার অভিনয়। নদু আর বাকি লোকজন হৈ হৈ করে মঞ্চে উঠে তাকে উদ্ধার করলো।
কতৃপক্ষ গাড়ির বন্দোবস্ত করে দিলো।
গাড়িতে উঠে চোখ মেললো শ্যমলাল। নদুর কোলে তার মাথা। বেশ অবাক হয়ে সে বললো ,”এ লেখা আমার নামে গেল কি করে ?”
নদু বললো,” পকেটে কাগজটা ছিল। মেয়েটাকে গিয়ে বললাম যে তুমি একটু আগে এটা লিখেছ। আর তুমি চাও যে এটা আবৃত্তি হোক। কবিতার ওপর তোমার নাম লিখে দিয়ে দিলাম।আর তারপর তুমি সবই জানো।”
শ্যমলাল বললো,” কিন্ত তোমার নামে দিলে তো তুমি নাম করতে পারতে।”
নদু বললো ,”না হে। জগৎটা বড় নির্মম। এখানে তেলা মাথায় তেল পড়ে। নতুন লেখকের ভালো লেখা অগ্রাহ্য করে ফেলে রেখে দেয় কিন্তু নামি লেখকের ছাইপাশ সাহিত্যও বই হয়ে প্রশংসা কুড়োয়। তোমরা মানোনা। তাই একটা প্রমান দিলাম হাতে নাতে।”
শ্যমলাল ততক্ষনে উঠে বসেছে। নদুর হাতটা চেপে বললো ,”একটা লেখা দাও তোমার। আমার পত্রিকায় ছাপবো। যাতে তুমি স্বচ্ছন্দ, সেই সাবেকি ভাষা হলেও চলবে। কবিতাকে কোন গন্ডি দিয়ে বাঁধা যায়না। “
নদু মুচকি হেসে বললো ,”থ্যাংক ইউ”
******************************************
শান্তনু মুখার্জ্জী (জয়)
#SantanuStory