অজপা তার বিয়ের দু বছরের মাথায় স্বামী হারিয়ে এইটুকু বয়েসে বিধবা হবে সেটা সে চরম দুঃস্বপ্নেও ভাবেনি । কিন্তু ললাটের লিখন খণ্ডাবে কার সাধ্যি । বাইক একসিডেন্ট কেড়ে নিল তরতাজা একটা প্রাণ। অজপার স্বামী কল্লোল ।
কল্লোল আর অজপার আলাপ ফেসবুকে। দু একজন মিউচুয়াল ফ্রেন্ড আছে দেখে ফ্রেন্ড রিকুয়েস্টটা কল্লোলই পাঠায় । অজপা একসেপ্ট করেছিল ঠিক দেড় দিন পর । তারপর ফেসবুক চ্যাট সেখান থেকে হোয়াটস আপে গুড মর্নিং , গুড নাইট উইশ আর সব শেষে একদিন গোলপার্ক ক্যাফেতে দেখা । সাত মাসের মধ্যেই বিয়ে। কেরালায় হানিমুন। চুটিয়ে সংসার। উইকেন্ডে লং ড্রাইভ । সব মিলিয়ে দারুন কাটছিল দিনগুলো । কিন্তু ওই একটা একসিডেন্ট ও কল্লোলের মৃত্যু অজপার জীবনটা তছনছ করে দিলো।
প্ৰথম দুদিন তো গলা থেকে কথাই বেরোয়নি। পাথরের মত হয়ে গেছিল ।
অজপার বাবা একদিন এসে ওর শ্বশুর শ্বাশুড়ির অনুমতি নিয়ে ওকে নিয়ে গেলেন।
তারপর কেটে গেছে প্রায় পাঁচ বছর । অজপা এখন অনেক স্বাভাবিক ।
কিছুদিন হলো আবার ফেসবুক , হোয়াটস আপ শুরু করেছে । একটা চাকরিও জয়েন করেছে।
নতুন অফিসের বস প্রীতম চৌধুরী কল্লোলের পুরোনো বন্ধু। সে-ই চাকরিটা করে দেয়। তার সাথে একটা অজান্তেই সম্পর্ক তৈরী হয়েছে অজপার । এ প্রেমের জন্ম অনুকম্পার থেকে। এখন ওদের বিয়ের কথা চলছে ।
প্রীতম অফিসের শেষে সেদিন রোজকার মত অজপাকে ড্রপ করে দিয়ে যাবার সময় বলে গেল ,”এক ঘন্টা পর অনলাইনে এস । কথা হবে। ”
অজপা নির্ধারিত সময়ের কিছু আগেই ল্যাপটপ খুলে অনলাইন হয়েছে । এখনো প্রীতম আসেনি । হটাৎ একটা টিং করে শব্দ হলো। চ্যাট নোটিফিকেশন। প্রীতম ? সেও আগেই এসে গেছে ?
অজপা ক্লিক করলো। কিন্তু একি ! কোথায় প্রীতম । যার চ্যাট মেসেজ এসেছে তাকে সে হারিয়েছে পাঁচ বছর আগে । তার মৃত স্বামী কল্লোল। কল্লোল লিখেছে –
– ” কয়েকটা কথা আছে । এখন বলতে পারি ?”
ঠিক এই ভাবেই কল্লোল প্রথম দিকে লিখতো । আর অজপা এটা নিয়ে পরে অনেক মজা করেছে।
অজপা কি লিখবে ভেবে পেলো না। এটা কি করে সম্ভব ? সে কল্লোলকে দাহ হতে দেখেছে । সে কি করে ফিরবে ? তবে কি কেউ কল্লোলের পাসওয়ার্ড জানত আর সে এখন মজা করছে ? কিন্তু কে সে ?
এর মধ্যে আবার দেখাচ্ছে ‘কল্লোল টাইপিং ।’
আবার লেখা এলো ,” বিশ্বাস হচ্ছে না তো । কিন্তু বিশ্বাস করো । আমি আসতে চাইনি। তুমি আবার বিয়ে করে সুখী হও সেটা আমিও চেয়েছিলাম । কিন্তু তুমি প্রীতমকে বিয়ে করোনা ।”
আবার সব চুপ ।
অজপা ভয়ে দেয়ালে সিঁটিয়ে গেছে। এটা কি হচ্ছে ?
আবার দেখা গেল “কল্লোল টাইপিং”
-“একটা কথা তোমায় বলি । আগে বলার সুযোগ হয়নি । প্রীতম আমাদের বিয়ের পর থেকেই তোমার বিশেষ গুণমুগ্ধ ছিল। একবার নেশার ঘোরে আমায় বলেছিল যে আমার সাথে বিয়ে না হয়ে তোমার যদি অন্য কারো সাথে বিয়ে হত তাহলে ও তার সাথে তোমার ডিভোর্স করিয়ে তোমায় বিয়ে করত। কিন্তু আমি সেটা তখন গুরুত্ব দিইনি ।”
আবার থামলো লেখা ।
অজপা এবার মনে সমস্ত সাহস একত্রিত করে লিখলো ,” আমি জানি কেউ কল্লোলের প্রোফাইল হ্যাক করে কথা বলছে। কিন্তু কোনো লাভ হবে না। আমি প্রীতমকেই বিয়ে করব ।”
আবার দেখা গেল কল্লোল টাইপিং । লেখা এলো
“বিশ্বাস হলো না তো । ভিডিও চ্যাটটা একবার অন করো তো । তোমায় একটা জিনিস দেখাই।
বলতে বলতে ম্যাসেঞ্জের থেকে একটা রিং হতে শুরু করলো। কল্লোল কলিং । ভিডিও কল।
কি করবে অজপা । রিসিভ করলে কাকে দেখবে ? কল্লোল না অন্য কেউ ?
একরকম কৌতূহলী হয়ে রিসিভ করেই ফেললো অজপা। ভিডিও উইন্ডো খুলে গেল।
বাইপাসের রাস্তা। কল্লোল বাইক চালাচ্ছে । সেদিন এই হলুদ স্ট্রাইপ জামাটাই পরেছিল সে।
পেছনে একটা গাড়ি। এস ইউ ভি । কালো রঙের। অজপা এই গাড়িটা চেনে । এই গাড়িতে করেই প্রীতম তাকে রোজ নামিয়ে দিয়ে যায় ।
কল্লোলের বাইক বাইপাস ছেড়ে চিংড়িহাটা পেরিয়ে বাঁদিকে রাস্তায় ঢুকলো। সাথে প্রীতমের কালো গাড়িটাও ঘুরলো। প্রীতমকে দেখা যাচ্ছে এবার। এটা সরু রাস্তা। আলো কম। এস ইউ ভির জোড়ালো আলোটা গিয়ে পড়েছে কল্লোলের ওপর। ওকে পেছনে থেকে দেখা যাচ্ছে। অজপা যেন রুদ্ধশ্বাস সিনেমা দেখছে। এই রাস্তাটার নাম ক্যানাল রোড। রাস্তাটা চিরে মাঝখান দিয়ে একটা খাল বয়ে গেছে। বর্ষায় ভরা খালে যেন নদীর জলস্রোত । একি ! প্রীতমের গাড়ি মূখ ঘোরালো । এবার বাইকের একদম কাছে। কিছু বোঝার আগেই একটা সজোরে ধাক্কা বাইকে । বাইক তিন পাক খেয়ে খালের জলে। রাত ১টা। সুনসান রাস্তায় কেউ জানতেও পারলোনা কি ঘটে গেল। কালো এস ইউ ভি নিয়ে বেরিয়ে যাবার আগে প্রীতম মুখ বাড়িয়ে দেখলো খালের কালো জলে যেটা দেখা যাচ্ছে সেটা হোল বাইকের হেডলাইটের একটা অংশ ।
ভিডিও চ্যাট স্ক্রিন কালো হয়ে গেল। কানেকশান কেটে গেছে।
অজপার শরীর ঘামে ভিজে গেছে। চোখ বিস্ফারিত। হটাৎ পাশে আরেকটা চ্যাট উইন্ডোতে রিং শুরু হলো। প্রীতম এসে গেছে। কি করবে অজপা বুঝতে পারলোনা। কল্লোলের চ্যাট তখনও খোলা। সেখানেই লেখা এলো।
-” প্রীতমের কলটা রিসিভ কর।”
অজপা রিসিভ করলো ।
প্রীতম স্নান করে ফ্রেস হয়ে চুল আঁচড়ে বসেছে ।
হেসে বললো , “এতক্ষন রিং হচ্ছে দেখে ভাবলাম ঘুমিয়ে পড়েছো বোধহয় ।”
অজপা চুপ।
প্রীতম আবার বললো ,” অজপা কি হয়েছে ? তোমায় এরকম লাগছে কেন ?”
অজপা এবার একটা অদ্ভুত প্রশ্ন করলো।
-“তোমার কালো গাড়ির সামনে রক্তের দাগ কেন ?”
প্রীতম হকচকিয়ে গেল। তারপর নিজেকে সামলে বললো ,” এসব কি বলছো অজপা। আমি তো কিছুই বুঝতে পারছিনা। এই শোন কাল ছুটি। বিকেলে বেরোবে ? কোথায় যাবে বলো। আমি নিয়ে যাবো ।”
অজপা বললো ,” যেখানে বলবো সেখানে নিয়ে যাবে ?”
প্রীতম আশ্বাস দিয়ে বললো “নিশ্চয়ই”
অজপা বললো ,”তাহলে কাল বিকেলে নয়।
এখনই চলো।”
প্রীতম অবাক হয় বললো ,”অজপা এখন রাত এগারোটা। তোমার বাড়ি গিয়ে তোমায় নিয়ে বেরোতে রাত বারোটা বেজে যাবে ”
অজপা ছোট্ট করে উত্তর দিলো ,” হোক না। ক্ষতি কি ?”
অজপাকে তুলে প্রীতম যখন বেরোলো তখন রাত বারোটা বেজে দশ মিনিট ।
প্রীতম বললো, ” বলো কোথায় যাবে ।”
অজপার আবার ছোট্ট উত্তর ,” আমি বলে যাচ্ছি তুমি চলো।”
রাতের বাইপাস দিয়ে ছুটে চলেছে একটা কালো এস ইউ ভি ।
চিংড়িহাটা পেরিয়ে অজপা বললো বাঁদিকে ঘোরাতে।
প্রীতম মৃদু আপত্তি করে বললো ,” এদিকে কিছু নেই। সুনসান রাস্তা।”
অজপা বললো ,” ওই দিকেই যেতে হবে আমায় ”
রাত একটা। অজপা খালের ধরে গাড়ি দাঁড় করাতে বললো ।
প্রীতম এবার যেন একটু ঘাবড়ে গেছে। সেই ভাব লুকিয়ে প্রায় বজ্র কঠিন গলায় বললো ,”তোমার মতলবটা কি বলো তো ?”
অজপা গাড়ির দরজা খুলে নামার আগে বলে গেল , “আমার একটা প্রিয় জিনিস খালে পড়ে গেছে । তুলে এনে দেবে ?”
প্রীতমও গাড়ি থেকে নেমে পড়েছে । অজপা গিয়ে দাঁড়িয়েছে খালের ধারে । প্রীতম এসে তার পাশেই দাঁড়ালো। তার মনে তোলপাড় চলছে । অজপা কি সব জেনে গেল ? কিন্ত কি ভাবে ? পুলিশ পর্য্যন্ত এটা একসিডেন্ট মেনে নিয়েছে ।
অজপা প্রীতমের দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে বললো ,” তোমার গাড়ির রক্তের দাগটা এখনো ধুয়ে ফেলনি ? ওটা কল্লোলের রক্ত । ওটা আমি চিনি ”
প্রীতমের ভাব মুহূর্তে বদলে গেল। যে চোখে এতক্ষণ অনুরাগ ছিল সেটা পরিণত হলো রাগে ।
চাপা ঘরঘরে গলায় সে বললো ,”জেনে ফেলেছিস তাহলে। কি ভাবে জানলি সেটা জেনে আর সময় নষ্ট করবো না। তার থেকে তোকেও ওই খালেই ডুবিয়ে দি।”
অজপা নির্বিকার। কোন কথা ওর কানে গেছে বলে মনে হলো না ।
ঠিক এই সময় রাতের নিস্তব্ধতা খানখান করে বেজে উঠলো প্রীতমের মোবাইল। প্রীতম অন্যমনস্ক ভাবে ফোনটা ধরে ফেলল। অজপার বাবার ফোন। ভদ্রলোক প্রায় আর্তনাদ করে বলে উঠলেন, ” প্রীতম । সর্বনাশ হয়ে গেছে বাবা। অজপা বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করেছে। আমার সামনে ওর নীল শরীরটা পড়ে আছে। ও কেন এমন করলো ? সব তো ঠিক হয়ে গেছিল। একবার এস তুমি। একবার এস।”
ফোন কেটে গেল । প্রীতম হতবুদ্ধির মত চেয়ে আছে অজপার দিকে। অজপা এক দৃষ্টে তাকিয়ে খালের জলে। সে এখনো বল চলেছে , ” প্রীতম , আমার একটা প্রিয় জিনিস খালে পড়ে আছে। তুলে এনে দেবে ?”
শিরদাঁড়া দিয়ে ঠান্ডা স্রোত নেমে গেল প্রীতমের। কান্ডজ্ঞানহীন হয়ে লাফিয়ে পড়লো অজপার ওপর। আর ঠিক তখনই একটা চোখ ধাঁধানো বাইকের আলো ওর চোখে পড়ে মুহূর্তের জন্য ওকে ধাঁধিয়ে দিলো। প্রীতম চোখ সরিয়ে নিল। আর তারপর দেখলো আলোর সুড়ঙ্গ পথ থেকে একটা বাইক তার দিকে ছুটে আসছে। আর বাইকে বসে হলুদ স্ট্রাইপ জামা পড়া কল্লোল। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছেনা সে। মুহূর্তের মধ্যে বাইক চলে এলো তার এক্কেবারে সামনে আর তারপরেই একটা সজোরে ধাক্কা । প্রীতম ছিটকে গিয়ে পড়লো খালের জলে। । বাইকের আলোয় অজপা দেখল প্রীতমের স্মার্ট ওয়াচ পরা বাঁ হাতটা আস্তে আস্তে জলের ওপর কিছুক্ষণ হাবুডুবু কেটে মিলিয়ে গেল।
অজপার সামনে বাইক। আর তাতে বসে কল্লোল।
অজপা এবার হাসলো। তারপর বাইকের পেছনে বসে কল্লোলকে আঁকড়ে ধরলো। রাতের অন্ধকার ভেদ করে বাইক মিলিয়ে গেল।
পরদিন সকালে প্রীতমের লাশ পাওয়া গেলো সল্টলেকের কাছে ওই খালেরই জলে। বর্ষার ভরা খালে অনেকটা ভেসে এসেছিল।
এখনো নাকি অনেকে রাতে দেখতে পায় বাইকে চড়ে অজপা আর কল্লোল মিলিয়ে যাচ্ছে রাতের অন্ধকারে। ওদের দেখে বেশ সুখী বলেই মনে হয়।
**************
শান্তনু মুখার্জ্জী (জয়)