ফিসফিস – শান্তনু মুখার্জ্জী (জয়)

***********************************

Santanu , Joy

তরুণ সাইক্রিয়াটিস্ট ডঃ তন্ময় মিত্র সেদিন রাতের শেষ পেশেন্ট দেখে চেম্বার থেকে বেরোতেই শুরু হলো ঝমঝম করে বৃষ্টি। সে বৃষ্টির দাপট এতটাই যে তাঁর পক্ষে কিছুটা দূরে রাখা গাড়ি অবধি যাওয়াটাও প্রায় অসম্ভব। তন্ময় বাবু ডাক্তার হলেও একজন আদ্যোপান্ত ক্রিয়েটিভ মানুষ। ভালো ছবি আঁকেন। নিজে গান করেন আবার বাড়িতে রাখা পুরোনো পিয়ানো বাজিয়ে সুর করেন। বৃষ্টির এই শব্দ তাঁর খুব প্রিয়। কিন্তু এই পরিস্থিতে নয়। রাত প্রায় সাড়ে নটা। খিদেও পেয়েছে। এই সময় তেলে বেগুন ছাড়ার শব্দ বৃষ্টির এই অবিরাম শব্দের চেয়ে অনেক ভালো। সত্যি পরিস্থিতি মানুষকে কতটা পাল্টে দেয়। এটাও তো একধরণের সাইকোলজির বিষয়। শব্দ আর সাইকোলজি । বিষয়টা বেশ ভালো। ওই বৃষ্টির ভেতর দাঁড়িয়েই ঠিক করে ফেললেন এর ওপর একটা পেপার লিখবেন।

তিনি এতটাই চিন্তায় ডুবে ছিলেন যে কখন তাঁর পাশে এসে আর একজন লোক দাঁড়িয়েছেন সেটা তিনি খেয়াল করেননি ।

– “আপনার চেম্বার কি শেষ ?” প্রশ্নটা এলো আগন্তুকের কাছ থেকে।

ডঃ মিত্র একটু চমকে তাকালেন।

ভদ্রলোকের বয়েস প্রায় পঞ্চান্ন । সাদা চুল। সোনালী ফ্রেমের চশমা । পরনে পায়জামা আর পাঞ্জাবি। বেশ সম্ভ্রান্ত চেহারা।

অন্য সময় হলে তন্ময় বাবু “হ্যাঁ চেম্বার শেষ। আজ আর রুগী নয়” বলে এড়িয়ে যেতেন । কিন্তু আজ এই বৃষ্টির মধ্যে দাঁড়িয়ে না থেকে একটা রুগী দেখাই ভালো এই ভেবে বললেন , “যা বৃষ্টি তাতে তো বেরোতে পারবোনা। তাই একজনকে দেখতে পারি। তা রুগীটা কে ”

আগন্তুক বললেন , “আমি। খুব বিপদের মধ্যে আছি ”

“ভেতরে আসুন ” বলে ভদ্রলোককে নিয়ে চেম্বারে ঢুকলেন ডঃ মিত্র।

এই নতুন পেশেন্ট জানালেন তাঁর নাম বিনোদ বিশ্বাস । রামপুরহাটের কাছে যে জমিদার বাড়ি আছে সেই বাড়ির ছেলে তিনি। সম্প্রতি কলকাতায় শ্যামবাজার অঞ্চলে বাড়ি কিনে উঠে এসেছেন।

তন্ময় বাবু প্রশ্ন করলেন ,” আপনার সমস্যাটা একটু খুলে বলুন। কিছু লুকবেন না ”

বিনোদবাবুর মুখে একটা আতঙ্কের ছাপ নেমে এলো। তারপর ধরা গলায় বললেন , ” আপনি ভূতে বিশ্বাস করেন ?”

ডঃ মিত্র একটা অবজ্ঞার হাসি দিয়ে বললেন ,”বিজ্ঞান যাকে স্বীকার করেনা তাকে ডাক্তার হয়ে কি করে মানি ?”

বিনোদবাবু একই রকম গলায় বললেন ,” আমিও করতামনা জানেন। কিন্তু এখন করি। আর তাই আপনার কাছে আসা। ”

ডঃ মিত্র বললেন ,” আরেকটু বিস্তারিত ভাবে বলুন ”

বিনোদবাবু বলে চললেন।

” শ্যামবাজারের বাড়িটা কেনার পর কদিন ভালোই চলছিল। সব ভালো বাড়িটার। একটাই সমস্যা। আর তা হলো গাড়ির আওয়াজ । গ্রামের দিকে থাকতাম। চুপচাপ জায়গা। আর এখানে সারাক্ষন হর্ন , হকার আর ঝগড়ার পাঁচ মিশালী মস্রণে কেমন অতিষ্ঠ লাগতো। সে সব তাও মেনে নিয়েছিলাম। কিন্তু কিছুদিন হলো এক অদ্ভুত জিনিষ শুরু হয়েছে ।

– “কি সেটা ?”

-“আমার কানে কানে কেউ সারাক্ষন কথা বলে। অথচ আশেপাশে কেউ থাকেনা।”

-” কি বলে ?”

– “বুঝতে পারিনা। কিন্তু অনবরত কথা বলে যায়।আমি আর পারছিনা । ডঃ মিত্র । আপনি কিছু একটা করুন । আমি পাগল হয়ে যাবো। আমার খালি মনে হয় ওই বাড়িতে আমি ছাড়া আরো লোক আছে। তাদের দেখা যায়না। কিন্তু ফিসফিস করে কানের সামনে এসে তারা কথা বলে।”

তন্ময়বাবুর কাছে এটা একটা অদ্ভুত সমস্যা। আগে এমন ভূতের চিকিৎসা করেননি। তিনি একটু ভেবে জিগেস করলেন ,

“সব সময় শোনেন ? এখনো শুনছেন কি ?”

ভদ্রলোক বললেন ,”না। রাস্তায় শুনিনা । শুধু বাড়িতে। সকালের দিকে বেশি শুনি। সারাক্ষণ কানে কানে কি যে বলে। জানেন ওঝা ডেকে ছিলাম। সে লঙ্কা পোড়া দিয়ে গেল। কিন্তু কিছুই হলো না।”

বিনোদবাবুর যা অবস্থা তাতে তন্ময় বাবু আর ওঝা ডাকার মত অবৈজ্ঞানিক কাজ কেন করেছেন সেটা আর জিগেস করলেন না।

প্যাড খুলে ওষুধ লিখে বললেন , “ঘুমের একটা বড়ি দিচ্ছি। এটা খান । আমার মনে হয় না ঘুমিয়ে একটা হালুসিনাশন হচ্ছে আপনার।”

বিনোদবাবু বিদায় নিলেন। খুব সন্তুষ্ট হয়েছে বলে মনে হলোনা।

দিন সাতেক পর ডঃ মিত্র গেছেন ডানলোপে এক আত্মীয়ের বাড়ি। রাত প্রায় দশটা । আবার ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি। কোন যানবাহনের চিন্হ নেই। বাড়ি ফেরার জন্য কিছুই পাচ্ছেনা । ড্রাইভার নেই। ছুটিতে । তাই ট্যাক্সি করে এসেছেন। ফেরার সময় কোনোরকমে একটা বাসে শ্যমবাজারে এসে দাঁড়িয়ে আছেন। এমন সময় শুনলেন কে যেন ডাকলো ,”ডাক্তার বাবু ”

চমকে তাকালেন । বিনোদ বিশ্বাস। একটা ছাতা নিয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে।

তন্ময়বাবু অবাক হয়ে বললেন , “একি আপনি ? এই বৃষ্টিতে বাইরে কেন ?”

বিনোদ বাবু প্রায় ভেঙে পড়ার মত হয়ে বললেন ,,” পারছিনা ডাক্তারবাবু । আর পারছিনা। ঘরে ঢুকলেই কানের কাছে সেই চাপা গুঞ্জন। কারা আমার কানে কানে কথা বলেই চলেছে। আমি বাড়ি ঢুকতে পারছিনা। ”

তন্ময়বাবুর কি খেয়াল হলো বিনোদ বাবুর কাঁধে হাত রেখে বললেন , “চলুন । আমি যাচ্ছি”

বিনোদ বাবু আবেগে প্রায় ফেটে পড়ে বললেন ,”সত্যি যাবেন । চলুন”

বিনোদ বাবু একটা পেল্লায় ফ্ল্যাটে একাই থাকেন। বৃষ্টির বিরাম নেই। তন্ময় বাবু থাকেন বালিগঞ্জ এলাকায়। ফেরা অসাধ্য না হলেও মুশকিল। তাই ঠিক হলো সেই রাতটুকুর মত তন্ময় বাবু বিনোদ বাবুর বাড়িতেই থাকবেন। বাড়ির লোককে খবর দিয়ে হাত মুখ ধুয়ে গেস্ট রুমে ঢুকে গেলেন তিনি।

খাটে শুয়ে একটা সাইক্রিয়াট্রির জার্নাল খুলে পাতা ওল্টাতে লাগলেন। হঠাৎ দরজার দিকে চোখ গেল। দুটো পাল্লার ফাঁক দিয়ে দেখলেন বিনোদ বাবু জল খেলেন। চার্জার থেকে ফোন খুলে ইয়ার প্লাগ লাগিয়ে কানে গুঁজলেন। তারপর শুতে চলে গেলেন ।

চোখ লেগে এসে ছিল ডঃ মিত্রর । হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল। ঘড়ির কাঁটা বলছে রাত একটা পনেরো। কি মনে হতে তিনি উঠে গেলেন বিনোদ বাবুর শোবার ঘরে।

বিনোদ বাবু ঘুমোচ্ছেন। বুকের ওপর হাত জড় করা। পাশে মোবাইল ফোন। ইয়ার প্লাগ কানে।

কি শুনতে শুনতে ঘুমাচ্ছেন বিনোদ বাবু। কৌতূহল হলো তন্ময়বাবুর। সন্তর্পনে ইয়ার প্লাগ খুলে কানে দিলেন। তারপর একটা মুচকি হাসি দেখা গেল তাঁর মুখে।

নিজের ঘরে এসে শুয়ে পড়লেন তন্ময় বাবু।

পরদিন সকালে বিনোদ বাবুকে জিগেস করলেন ,”রাতে ইয়ার প্লাগ লাগিয়ে কি শোনেন?”

বিনোদ বাবু একটু লজ্জা পেয়ে বললেন ,”ওই একটু রেডিওতে গান শুনি শোবার আগে”

“কত দিনের অভ্যেস। মনে হয়না খুব বেশি দিনের” বললেন ডঃ মিত্র।

বিনোদ বাবু হাত টা দুবার নেড়ে বললেন ,”না না ,এই হালের অভ্যেস । এ বাড়িতে আসার পর ”

তন্ময় মিত্র বললেন ,”ওটা এবার বন্ধ করুন। সারাদিন অন্যসময় শুনুন। কিন্তু রাতে নয়। ওটাই যত নষ্টের মূল।”

বিনোদ বাবু অবাক হয়ে বললেন ,” সে আবার কি রকম কথা ”

তন্ময়বাবু চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বললেন ,”কাল রাত একটা নাগাদ আমি আপনার ঘরে গিয়ে আপনার কান থেকে হেডফোন খুলে নিজে শুনেছি। তখন গান শেষ হয়ে গিয়ে একটা রাজনৈতিক বিতর্ক অনুষ্ঠান হয়। সবাই চিল চিৎকার করছে সেখানে নিজের যুক্তি প্রমান করতে। সেটা কি আপনি কখনো শুনেছেন ?”

অবাক হয়ে বিনোদ বাবু বললেন ,”না । নেভার”

তন্ময়বাবু বলে চললেন। “কিন্তু আপনি শুনেছেন। রোজ শোনেন। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে। ইয়ারপ্লাগ কানে দিয়েই আপনি ঘুমিয়ে পড়েন। আর এই তর্ক বিতর্ক, চিৎকার প্রভাব ফেলেছে আপনার অবচেতন মনে। আর তাই আপনি যখন জেগে থাকেন এই বাড়ির পরিবেশে সেই অবচেতন মনে লুকিয়ে থাকা শব্দ গুলো আপনার কানে বাজে যেটা আপনার মনে হয় কেউ কথা বলছে আপনার কানে। আপনি আগেই বলেছিলেন শ্যামবাজার মোড়ের ট্রাফিকের আওয়াজ বা হকারের চিৎকার আপনাকে বিব্রত করে। অর্থাৎ আপনার শ্রবনেন্দ্রিয় ভীষণ সেনসিটিভ। আর তাই রাতে কানের মধ্যে বাজতে থাকা ওই চিৎকার গুলো সারাদিন আপনার ব্রেনে ঘোরে যার থেকে আপনার মনে হয় যে আপনার কানে কানে কেউ কথা বলছে। অন্যসময় বা বাড়ির বাইরে এটা হয়না তার কারণ আপনার মাইন্ড স্পেস তখন অন্য জনিসে অকুপাইড থাকে। যেমন কাল রাতে আমি ছিলাম আপনার সাথে আর সে সময় কিন্তু আপনার একবারও মনে হয়নি। তাই বলছি ওই অভ্যাসটা ছাড়ুন। সুস্থ হয়ে যাবেন। ”

হতবম্ভ বিনোদ বাবু বললেন ,” কিন্তু কিছু না শুনলে তো আমার ঘুম আসোনা। ”

ডঃ মিত্র মুচকি হেসে বললেন,” সে ব্যবস্থা আমি আপনাকে করে দিচ্ছি । ঘুম পাড়ানি মিউজিক। একে Bio Music বলে। সম্পুর্ন বিজ্ঞান সম্মত। কোনো সাইড এফেক্ট নেই। ঘুম পাড়ানি গান যেমন বাচ্চাদের ঘুম পাড়ায় ঠিক তেমন এই সুর আপনাকে ঘুম পাড়াতে সাহায্য করবে। নিন আপনার ব্লু টুথটা অন করুন। আমি ট্রান্সফার করে দিচ্ছি”

************************************
শান্তনু মুখার্জ্জী (জয়)

(আমি কৃতজ্ঞ পন্ডিত সঞ্জয় চক্রবর্তী মহাশয়ের কাছে । ওনার থেকেই আমি BIO Music এর ব্যাপার প্রথম জানতে পারি আর তারপর এই প্লটটা মাথায় আসে )

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *