জায়গাটা কলকাতা থেকে বেশি দূরে নয়। দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার কাকদ্বীপের কাছে এই গ্রাম। নাম বিরুহা । সেখানে ভয়াল কালীর পূজো খুব বিখ্যাত । মায়ের রূপ সত্যি ভয়াল। হাতে মুন্ড আর গলায় মুন্ডমালার থেকে ক্রমাগত ঝরে পরছে রক্ত বিন্দু। মায়ের মুখেও রক্তের দাগ। অসুর নিধন করে তার রক্তে মা যেন তৃষ্ণা নিবারণ করছেন। বেশিক্ষন সে কালীর দিকে তাকিয়ে থাকা যায়না। বুক কেঁপে ওঠে। সে কালীর পুজো ও যে সে পুরোহিত করতে পারেনা। এই পুজোর জন্য গ্রামবাসীরা নিয়ে আসে তারাপীঠের শ্মশান থেকে তান্ত্রিক বিভরানন্দকে। সে পুজো পদ্ধতিও ভারি অদ্ভুত। সেখানে পাঁঠা বলি তো হয়েই। তাছাড়া আরেকটি জিনিস লাগে। আর তা হলো নর রক্ত। কথিত আছে বহু বছর আগে এখানে নর বলিও হত। কালীপূজার আগে গ্রামবাসীরা অনেকে গ্রাম ছেড়ে পালাত। এখন নর বলি বন্ধ হলেও নর রক্ত লাগে। আর গ্রামের অনেকে আঙ্গুল বা বুক চিরে সেই রক্ত দেয়। রক্ত জমা করা হয় একটা তামার পাত্রে। পূজো শুরু হলে সেই তান্ত্রিক পুরোহিত আকন্ঠ সূরা পান করে হোম শুরু করেন। হোমের আগুন কতটা উঠল তার ওপর নাকি গ্রামবাসীদের ভাগ্য নির্ধারিত হয়। । সেই নর রক্ত ভরা পাত্রটি হোমকুণ্ডে আহুতি দিলেই দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে আগুন। আর তান্ত্রিকের মদিরা জড়ানো কণ্ঠে মা মা ডাকের সাথে মিলে যায় ঢাকের শব্দ আর কাঁসর ধ্বনি। পূজো সম্পন্ন হয়। এই নিয়ম চলে আসছে দীর্ঘ দিন। এ নিয়মের ব্যতিক্রম করার সাহস কারো নেই।
এতো গেল ভূমিকা। এবার আসা যাক আসল গল্পে। বছর কয়েক আগের কথা। গ্রামে মহামারীর মত দেখা দিল ডেঙ্গু। হাসপাতালে আর জায়গা নেই। রুগীদের স্থান হয়েছে মেঝেতে। চিকিৎসার উপযুক্ত সামগ্রীর জোগান নেই আর তাই মৃত্যুর হারও বেড়ে গেছে। রক্ত দেবার জন্য কলকাতা নিয়ে যাওয়া হচ্ছে গ্রামবাসীদের । গ্রামের ব্লাড ব্যাংক নাম মাত্রই আছে। সেখানকার ভাঁড়ার শূন্য।
এই সময় গ্রামে এলো নতুন ডাক্তার। নাম ডঃ সুদত্তা সিনহা। কলকাতাতে যোগাযোগ করে ওষুধ অনানো থেকে ডেঙ্গু থেকে মুক্তি পাবার উপায়ের ওপর জন সচেতনতা সব কিছুতেই তার উৎসাহের অভাব নেই।
সেবারের দুর্গা পূজোও খুবই অনড়ম্বরের সাথে পালন করা হলো। গ্রামের অধিকাংশ মানুষই ডেঙ্গুর শিকার। কে আয়োজন করবে পুজোর ?
এর পর লক্ষ্মী পূজো পার করে এলো কালী পূজো। ততদিনে ডেঙ্গু মহামারীর আকার ধারণ করেছে। ভয়াল কালীর প্রস্তুতি নিচ্ছে গুটি কয়েক গ্রামবাসী।
মণ্ডপে সেই ভয়াল দর্শনা রক্ত পিপাসি কালী মূর্তি এনে সবে রাখা হয়েছে। তারাপীঠ শ্মশানের তান্ত্রিকও এসে উপস্থিত। এমন সময় সেখানে ছুটতে ছুটতে এলেন গ্রামের জমিদার বাড়ির বড় ছেলে বিশ্বনাথ রায় চৌধুরী। তিনি থর থর করে কাঁপছেন। ঘামে ভেজা পাঞ্জাবি তাঁর দেহকে যেন আঁকড়ে ধরেছে।
পঞ্চায়েত প্রধান রতন রক্ষিত জিগেস করলো ,”ও কত্তা। কি হয়েছে গো?”
বিশ্বনাথ বাবু প্রায় কাঁপতে কাঁপতেই তান্ত্রিকের পায়ে লুটিয়ে পড়ে বললেন ,” ভয়ঙ্কর স্বপ্ন দেখেছি বাবা। আমি ভয়ঙ্কর স্বপ্ন দেখেছি ।”
রাশভারী গলায় তান্ত্রিক জিগেস করলো ,”কি স্বপ্ন দেখেছিস?”
– “বাবা। ভয়াল কালীকে দেখলাম। মা স্বপ্নে এসে বলছেন একশত মানুষের রক্ত চাই। না হলে এ রোগে গ্রামের সবাই শেষ হয়ে যাবে। কোথায় পাব একশো লোক ? অনেক কষ্টে কয়েকজনকে পাই যারা একটু করে রক্ত দিয়ে পুজোর নিয়ম রক্ষা করে। আমি কি করবো কিছুতেই বুঝতে পারছি না ।”
তান্ত্রিক কিছুক্ষন চোখ বুঁজে রইলেন। তারপর রক্ত জবার মত লাল চোখ মেলে বললেন, “মায়ের রক্ত পিপাসা মিটছেনা। একশ লোক চাই। তাদের রক্তে এবার পূজো হবে। নচেৎ ঘোর অমঙ্গল ।”
পরদিন গ্রাম শুনশান । কেউ রাস্তায় বেরোয়নি। যদি তাকে ধরে রক্ত বলিদান চাওয়া হয় এই আশঙ্কায় ।
ডঃ সুদত্তা সিংহ হাসপাতালের কাজ শেষ করে সবে বেরিয়েছে। দেখা হয়ে গেল দিনু মিস্ত্রির সাথে। দিনুর থেকেই সে জানলো এই ভয়ংকর নিদানের কথা। দিনু মিস্ত্রী সবে সেরে উঠেছে ডেঙ্গু থেকে। সে সুদত্তাকে ভগবান মানে। দিনু বললো ,”ডাক্তার দিদি ওই কালী পুজোর দিকেও যাবেন নি। ওরা আপনাকেও ছেড়ে কথা কইবে না। ওদের মাথায় খুন চেপেছে। ”
সুদত্তা একটু হেসে বললো ,” ভয় পাচ্ছো কেন ? মা যখন একশ লোকের রক্ত চেয়েছেন তখন আমার মনে হয় আমাদের সেটা করা উচিত। তাহলে মায়ের কৃপায় লোকগুলো সুস্থ হয়ে যাবে।”
এই বলে সে মুচকি হেসে পা বাড়ালো জমিদার বাড়ির দিকে।
বিশ্বনাথ বাবু বাইরেই বসেছিলেন। তাকে গিয়ে সুদত্তা জানালো যে একশ লোক সে জোগাড় করবে। এত বড় পূজো । ধুমধাম করে হবে তাই জমিদার বাবু যেন বাইরে একটা বড় প্যান্ডেল করে দেন।”
তাই হলো। বড় ম্যারাপ বাঁধা হলো। কালীপুজোর সকালে বিশ্বনাথ বাবু আর রতন রক্ষিত এলো সুদত্তার কাছে।
রতন রক্ষিত একটু সংকোচ নিয়েই জিগেস করলো ,”কি দিদি, লোক জোগাড় হবে তো?”
সুদত্তা একটা রহস্যময় হাসি দিয়ে বললো ,”বিকেল অবধি দেখুন না”
অমাবশ্যার সন্ধ্যে। আতসবাজির আলোয় আকাশ উজ্জ্বল হয়ে আছে। তান্ত্রিক হাতের খাঁড়াটা আগুনে সেঁকে শুদ্ধ করে নিলেন। এরপর হুঙ্কার দিলেন ,”ডাকো একে একে। ওই পাত্রে রক্ত জমা করো।”একে ওপরে মুখের দিকে চাইলো। কারও কোনো উত্তর নেই। তান্ত্রিক আবার হুঙ্কার ছাড়লেন। “দে । মাকে রক্ত দে। নইলে ঘর অনর্থ।”এমন সময় সবাইকে চমকে দিয়ে পর্দা ফেলা প্যান্ডেল থেকে বেরিয়ে এলো সুদত্তা। হাতে একটা পকেটে রক্ত। একটু নয় । অনেকটা। সেই রক্তের প্যাকেট কালী মূর্তির সামনে ধরে বলল ,” এই নাও মা রক্ত। তোমার কথা এরা বোঝেনি ।আমি বুঝেছি। “তান্ত্রিক চিৎকার করে উঠলো, “এ সবের অর্থ কি ?”সুদত্তা শান্ত গলায় বলল, “আপনারা প্যান্ডেলের ভেতরে আসুন”বিশ্বনাথ বাবু , রতন রক্ষিত আর তান্ত্রিক ভেতরে ঢুকে চমকে উঠলেন। কাতারে কাতারে লোক শুয়ে। সবার হাতে সূচ লাগানো। আর তার থেকেই রক্ত বেয়ে উঠে প্যাকেটে জমা হচ্ছে”এটা কি হচ্চে”? চিৎকার করে উঠলেন তান্ত্রিক।সুদত্তা বলল ,” ভেবে দেখলাম মায়ের কথাই ঠিক। একশ নর রক্ত পেলে ডেঙ্গু চিকিৎসার সুবিধে হবে। তাই এই রক্ত দান শিবির আয়োজন করে ফেললাম। একটু আসেপাশের গ্রাম থেকে উঠতি ছেলেদেরও এই বুদ্ধিটা বললাম। ওরাও সবাই রাজি হয়ে গেল। এই রক্ত এখন মাকে নিবেদন করে ব্লাড ব্যাংকে গিয়ে জমা থাকবে। ডেঙ্গু আক্রান্ত সবাই এবার সুস্থ হয়ে যাবে !”গুনে গুনে একশ জন একশ প্যাকেট রক্ত দিয়েছিল সেইদিন কালী পুজোর রক্ত দান শিবিরে।ডঃ সুদত্তা সিনহা আর নেই সেখানে। বদলি হয়ে গেছে বর্ধমানে। কিন্তু বিরুহা গ্রামে ভয়াল কালীর পূজো এখনো হয়। সে পুজোয় এখনো রক্ত লাগে। তবে সেখানে পাঁঠা বলি পর্য্যন্ত উঠে গেছে। যা রক্ত লাগে তা জোগান দেয় প্রতি বছরের ওই এলাকার সব চেয়ে বড় রক্তদান শিবির। সেটা গ্রামের ছেলেরাই আয়োজন করে। গ্রামের ব্লাড ব্যাঙ্ক আর কখনো কাউকে নিরাশ করে না।************************************শান্তনু মুখার্জ্জী (জয়)#SantanuStories