সিকুরিটি গার্ড – শান্তনু মুখার্জ্জী (জয়)

************************************

Santanu , Joyএয়ারপোর্টে ঢুকতেই ব্যাপারটা খেয়াল করলেন সুনন্দ রায়চৌধুরী। অনেকেই তাঁকে আড় চোখে দেখছেন । তারপর চাপা গুঞ্জন । সুনন্দবাবু কোনো ফিল্মস্টার বা ক্রিকেটার নন । তাই তাঁকে ঘিরে এই কৌতূহল খুব একটা স্বাভাবিক বা প্রত্যাশিত না। কিন্ত ব্যাপারটা ঘটছে এবং তাঁর অস্বস্তির কারণ বাড়িয়ে তুলছে ।

আয়ারব্রিজের সুড়ঙ্গ ছেড়ে ফ্লাইটে ওঠার সময় এবার কথাটা কানে এলো ।

– “চিনতে পারলি ?”

– ” হুম”

– ” কে বলতো ?”

– ” নামটা মনে পড়ছেনা । তবে ওই রয়েড স্ট্রিট মার্ডার কেসের ব্যাপারটা তো?”

– ” একদম ”

কথাগুলো আসছিল পেছন থেকে। চমকে উঠলেও ঘুরে তাকালেন না তিনি । এই আলোচনা হওয়াটাই স্বাভাবিক । যদিও তিনি খুন করেননি । আর এই খুনের সাথে কোনওভাবে যুক্তও নন ।

তবুও এই গত তিন দিন খুব ধকল গেছে । টিভি চ্যানেল থেকে খবরের কাগজ আছড়ে পড়ছে তাঁর ওপর। শহরে ঘটে গেছে নৃশংসতম হত্যা কান্ড।

সুনন্দ বাবু নাইট ভিশন নামক সিকুরিটি সংস্থার কর্নধার। এই সংস্থার এক সিকুরিটি কর্মী রয়েড স্ট্রিটের একটি আবাসনে গার্ড হিসেবে নিযুক্ত হয়েছিল। গত সোমবার হঠাৎ সে একজন বয়স্কা ভদ্রমহিলাকে তাঁর ফ্ল্যাটে নির্মম ভাবে হত্যা করে নগদ টাকা আর গয়না নিয়ে চম্পট দেয়। আসামী ফেরার। দিল্লি থেকে ডেকে আনা হয় সুনন্দ বাবুকে। মালিক হিসেবে তিনি দায়িত্ব এড়িয়ে যেতে পারেন না । ক্রমাগত জেরার পর শুরু হয়েছিল মিডিয়ার অত্যাচার। শেষে পুলিশের অনুমতি নিয়ে দিল্লি যাচ্ছেন তিনি। কথা দিয়ে গেছেন ডাকলেই আবার আসবেন।

এতবার করে টিভিতে দেখানোর ফলে তাঁর মুখটা বেশ বিখ্যাত হয়ে গেছে । সেটা তিনি ভালোই টের পেয়েছেন ।

ফ্লাইটে নির্ধারিত আসনে বসে বেল্টটা সবে লাগিয়েছেন ঠিক তখনই একজন পাশ থেকে একজন বলে উঠলো , “আপনি কি সুনন্দ রায় চৌধুরী ?”

চমকে তাকালেন তিনি । তবে কি এবার তাঁর পাশের যাত্রীও তাঁকে চিনে ফেললো ?

একটু ইতস্ততঃ করে “হ্যাঁ” বললেন সুনন্দ বাবু।

লোকটির দ্বিতীয় প্রশ্ন নাইট ভিশন সিকুরিটি এজেন্সিটা আপনার । একটা ঢোক গিলে আবার “হ্যাঁ” বললেন সুনন্দবাবু।

এবার পাশের ভদ্রলোক একটা অদ্ভুত প্রশ্ন করল।

– ” আপনি গত বছর কি একটা আয়ার্ড পেয়েছিলেন না ?”

আরে তাইতো । ভুলেই গেছিলেন সুনন্দবাবু । তিনি বণিক সভা থেকে গতবার সেরা উদ্যোগপতি পুরস্কার পেয়েছিলেন। এই গন্ডগোলে তাও ভুলে গিয়েছিলেন।

হঠাৎ তাঁকে সেই কারণে চিনতে পারায় তিনি যেন ধড়ে প্রাণ পেলেন।

-” ঠিকই ধরেছেন । তা আপনি কি আমাদের ব্যবসাতেই আছেন ?”

ভদ্রলোক দাঁত বের করে হেসে বলল ,”তা বলতে পারেন ”

-” আপনারও কি নিজের সিকুরিটি কোম্পানি ।” জিগেস করলেন সুনন্দ বাবু

লোকটি আরো একটা হাসি দিয়ে বলল ,”আজ্ঞে না। ”

সুনন্দ বাবু কৌতূহলী হয়ে প্রশ্ন করলেন ,”তাহলে ?’

লোকটি মুচকি হেসে বললো ,” আমি সিকুরিটি গার্ড ”

সুনন্দ বাবু একটা উন্নাসিক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন ,”ওঃ”

পাশের লোকটি তাঁর লেভেলের নন সেটা বুঝেই আর কথা বাড়ালেননা তিনি। একটা ম্যাগাজিন বের করে উল্টোতে থাকলেন আর ভাবলেন ,”এরাই সব নষ্টের মূল। লোয়ার ক্লাস । সাধে কি এরা খুন খারাপি করে। এদের বেশি লায় দিতে নেই। সুযোগসন্ধানী সুবিধাবাদীর দল । এই প্রাইভেট এয়ারলাইন্স গুলো এমন ভাড়া করে রেখেছে যে, যে কেউ আজকাল প্লেনে যাতায়াত করে। প্লেনে যাবার গৌরবটাই এখন আর নেই।”

এসব ভাবতে ভাবতেই লোকটা আবার জিগেস করলো , “আপনাকে কি এর মধ্যে কোথাও দেখেচি বলে মনে হচ্ছে । ”

প্রমাদ গুনলেন সুনন্দ বাবু। তাহলে কি এও জানে ?

লোকটা বলে চললো , “আপনি কি সম্প্রতি টিভিতে …. ”

কথা শেষ হলোনা। সুনন্দবাবু এতক্ষণের জমানো রাগ হতাশা একসাথে নিয়ে ফেটে পড়লেন। নিচু অথচ রুক্ষ গলায় বললেন, “আপনাদের মত সিকুরিটি গার্ডদের বদান্যতায় আমার খুব নাম ডাক হয়েছে গত কয়েকদিনে। ”

প্লেন তখন মাঝ আকাশে । মেঘের ওপর দিয়ে চলেছে প্রায় ২৮ হাজার ফুট উঁচুতে। এর একটু পরেই ল্যান্ড করবে । সিট বেল্ট লাগাবার ঘোষণা হলো।

লোকটা অবাক হয়ে বলল , ” সেকি ! আমি আবার কি করলাম ?”

সুনন্দ বাবু ঝাঁঝিয়ে উঠলেন, “আপনি মানে আপনার ক্লাসের লোকজন। আই মিন সিকুরিটি গার্ড। খুন করে ফেরার হয়েছে । আর সেই ঝক্কি আমায় পোয়াতে হচ্ছে । ”

লোকটা একটু আমতা আমতা করে বললো , “এটা কিন্তু অন্যায়। একজন কি করেছে বলে যারা দিন রাত আপনাদের সুরক্ষা নিশ্চিত করেছে তাদের আপনি এমন ভাবে অপমান করতে পারেন না। ”

প্লেন নামতে শুরু করেছে ।

সুনন্দ বাবুর মেজাজ তখন সপ্তমে । তাও নিচু অথচ কর্কশ গলায় বললেন , ” আপনাদের মত লোকেদের আবার মান আছে নাকি যে আমি অপমান করতে পারবো ? বাজে বিরক্ত করবেন না। আমি এমনিতেই খুব ডিসটার্বড আছি। ”

প্লেন মাটি ছুঁয়েছে । এবার রানওয়েতে ঘুরে দাঁড়াবে। সুনন্দ বাবুর একটু খারাপ লাগলো। বড্ড বাজে ব্যবহার করে ফেলেছেন। এই কদিনের পুলিশি হ্যাঙ্গমে তাঁর মাথা খারাপ হয়ে গেছে। একটা এপোলজি চেয়ে নেবেন ভাবলেন কিন্তু এবার পরক্ষনেই মনে হলো তাঁর মত হাই প্রোফাইল বিজনেসম্যানের জন্য এটা খুবই খেলো হয়ে যাবে। তাই অন্য একটা ফন্দি বের করলেন।

নিজের ভিজিটিং কার্ডটা বের করে লোকটির হাতে দিয়ে বললেন ,” কিছু মনে করবেননা । আমি একটু অসুবিধার মধ্যে আছি। আপনি যদি কোম্পানি চেঞ্জ করেন আমায় জানাবেন। আমি সিকুরিটি গার্ড নেব আমার কোম্পানির জন্য “

লোকটা এবার একটা অদ্ভুত হাসি দিয়ে বললো ,”আমি আমার কোম্পানি ছাড়লে আপনার সিকুরিটির সমস্যা হয়ে যাবে । তাই এই চাকরিটা আমি ছাড়তে পারবোনা ।”

সুনন্দ বাবু চমকে গেলেন। ভাবলেন, “কি বলে লোকটা। ও চাকরি ছাড়লে আমার সিকুরিটি বিপন্ন হবে ? এত অহংকার । এত স্পর্ধা! “

প্লেন দাঁড়িয়েছে। সবাই লাইন করে বেরোচ্ছে আর আয়ারব্রিজের সুড়ঙ্গে ঢুকে যাচ্ছে। লোকটির পেছনেই সুনন্দ বাবু। কৌতূহলী হয়ে জিগেস করলেন , ” আপনি কোথায় সিকুরিটি গার্ডের চাকরি করেন যে আপনি চাকরি ছাড়লে আমার সুরক্ষার সমস্যা হবে ?”

লোকটা একটু হাসলো। ততক্ষনে দুজনেই এয়ারপোর্টের গেটে ।

সুনন্দ বাবু বললেন , ” কি হলো ?উত্তর দিলেন না ? আপনি কোথায় পোস্টেড এস সিকুরিটি গার্ড”

লোকটা এবার ঘুরে দাঁড়ালো । চোয়ালটা শক্ত করে বলল , ” আমার নাম কর্নেল জিমুত মজুমদার । সিয়াচেনে পোস্টেড । কুমায়ন রেজিমেন্ট “

সুনন্দ বাবু কি প্রতিক্রিয়া দেবেন ভেবে পেলেন না। ততক্ষণে সামনের ভদ্রলোক বেরিয়ে গেছেন এয়ারপোর্টের বাইরে। সেখানে একটা হৈ হট্টগোলের আওয়াজ । বেরিয়ে এলেন সুনন্দ বাবু। প্রচুর লোক ফুল মালা দিয়ে বরণ করতে এসেছে তাঁর সহযাত্রীকে।

সুনন্দ বাবু একজন পুলিশকে জিগেস করলেন , “কি ব্যাপার বলুন তো।”

পুলিশটি গোলগোল চোখ করে বললো ,” কর্নেল জিমুত মজুমদার। সিয়াচেনে একা শত্রু পক্ষকে রুখে দিয়েছিলেন । এবার পরমবীর চক্র পুরস্কার পাচ্ছেন। “

সেরা উদ্যোগপতি পুরস্কার বিজয়ী সুনন্দ রায় চৌধুরির মুখে একরাশ ধোঁয়া ছেড়ে কর্নেল জিমুত মজুমদারের জিপটা বেরিয়ে গেল ।

*****************************************

শান্তনু মুখার্জ্জী (জয়)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *