ভগবানের বিচার – শান্তনু মুখোপাধ্যায় (জয়)

******************************************

Santanu Mukhopadhyaya

-“ কি গো মন্দিরে যাবে না ?”

স্ত্রী শান্তার প্রশ্ন শুনে ভট্টাচার্য্যি মশাই ঘড়ির দিকে আড় চোখে চাইলেন। সাড়ে আটটা। এতক্ষনে তাঁর মন্দিরে এক প্রস্থ পুজো হয়ে যায়। ঠাকুরকে স্নান করিয়ে , ফল ,মিষ্টি আর নকুলদানা দেয়াও সম্পন্ন হয়। আর তার জন্য পুরোহিত রমানাথ ভট্টাচার্য্যকে উঠতে হয় ভোর সাড়ে পাঁচটায়। আজ অবশ্যি উঠে পড়েছেন রাত থাকতে ; সেই ভোর চারটে। কিন্তু মন্দিরে যাবার কোনো উদ্যোগ নেই।

শান্তার সাথে তাঁর বিয়ে হয়েছে প্রায় বারো বছর। একটি মেয়ে আছে। নাম শ্রীরূপা। ডাকনাম কলি। বয়স আট। সে এখনো ঘুমোচ্ছে। রোজ স্কুলে যাবার আগে মন্দিরে গিয়ে বাবার পুজো গুছিয়ে দেয়।

এই দীর্ঘ বারো বছরে শান্তা কখনো দেখেননি ভট্টাচার্য্যি মশাইকে মন্দির না যেতে। তাই আজ তাঁর একটু অবাকই লাগলো।

রমানাথ বাবু স্ত্রীর কথায় একটা আলতো “না ” বলে ইজি চেয়ারটায় গা এলিয়ে দিলেন।

শান্তা বলে উঠলেন ,”সেকি ? ঠাকুর একটু মিষ্টি জল পাবেনা ?”

ভট্টাচার্য্যি মশাই এবার গর্জে উঠলেন, “ কি হবে খেয়ে ? যদি একটা বাচ্চা মেয়েকে কিছু পশুর হাত থেকে বাঁচাতে না পারে তাহলে ওই খাওনোর কোনো মানে নেই। মিথ্যে এতদিন পুজো করেছি। ভক্তি তাকেই করা উচিৎ যে তার মান রাখে। সেটা তিনি রাখেননি !”

শান্তা সভয়ে বলে উঠলেন ,”এসব বলোনা। পাপ লাগবে যে। ” এই বলে ক্ষমা চাওয়ার ভঙ্গিতে দু হাত জোড় করে কপালে ঠেকালেন।

রমানাথ বাবু চোয়াল শক্ত করে বললেন ,”কিসের পাপ? খেতে দিইনি বলে ? আর যে পশুগুলো ভগবানের সামনে একটা নিষ্পাপ মেয়েকে ছিঁড়ে খেলো তাদের তো কই পাপ লাগলোনা ? এই যদি ভগবানের বিচার হয় তাহলে আমার সেই ভগবানে কোনো ভক্তি নেই।”

শান্তা প্রশ্ন করলেন, “তাহলে কি তুমি পুজো ছেড়ে দিলে? “

ঠাকুরমশাইয়ের জবাব , “এক্কেবারেইনা। ভগবানকে একটা সুযোগ দিলাম। খুব তো বলেছিলেন – বিনাশায়চ দুষ্ককৃতম ! যেদিন ওই পশু গুলোর বিনাশ হবে সেদিন আমি আবার মন্দিরে যাবো। তার আগে নয়। ”

শান্তা ঠাকুরমশাইয়ের মুখ চেপে বললেন ,”পায়ে পড়ছি ওসব বোলোনা। আমার ভয় করে। তুমি একবার গিয়ে মিষ্টি আর জল দিয়ে এসো।”

রমানাথ বাবু একটা শ্লেষাত্মক হাসি হেসে বললেন , “বেশ। মেয়েকে ডাকো।“

শান্তা অবাক হয়ে বললেন ,”কেন ?”

ঠাকুরমশাইয়ের উত্তর ,”আজ আমি যাবোনা। মেয়ে একা গিয়ে পুজো করে আসুক। ”

শান্তা আকাশ থেকে পড়ার মতো করে বললেন ,”একটা আট বছরের মেয়েকে একা ছেড়ে দেবে মন্দিরে। যদি ওকেও …….”

শান্তাকে থামতে হলো। এরপরের কথাটা বলার ভাষা বা ক্ষমতা তাঁর নেই

রমানাথ বাবু বললেন ,”কি হলো বলো। শেষ করো।”

শান্তা মুখে আঁচল চাপা দিয়ে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন।

কেন জানি স্ত্রীর এই অবস্থা দেখে করুণা হলো রমানাথ বাবুর। শান্তাকে বললেন, “ ঠিক আছে। তোমার মনের শান্তির জন্য আমি জল মিষ্টি দিয়ে আসছি”

এই বলে পা বাড়াতে গিয়ে থমকে গেলেন। কিছুতে একটা বাধা পেয়েছেন। তাকিয়ে দেখলেন শান্তা এক দৃষ্টি তাকিয়ে ঘুমন্ত কলির দিকে। তাঁর এক হাত দিয়ে রমানাথ বাবুকে ধরে রেখেছেন আর একটা হাত কলির মাথায়।

খুব ধীর কণ্ঠে শান্তা বললেন , “ যেওনা। মেয়েটা বাঁচুক”

দূরে কোথাও তেত্রিশ কোটি মাথা একসাথে হেঁট হয়ে গেলো।

********************************************

শান্তনু মুখোপাধ্যায় (জয়)

#SantanuStory

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *