****************************************
ম্যাজিশিয়ান নন্দ সান্যালের একসময় খুব নাম ডাক ছিল। যে কোনো পাড়ার জলসায় নন্দ জাদুকর ছিল পরিচিত নাম। কাগজে আগুন জ্বেলে কৌটোর মধ্যে ভরে তার থেকে ফুলের মালা বের করা, খালি বাক্স থেকে পায়রা উড়িয়ে দেয়া এসব ছিলো তার জাদুর মুল আকর্ষণ। সব চেয়ে বেশি আকর্ষণ ছিল মানুষ কেটে জোড়া লাগাবার খেলা। নন্দ ছিল অত্যন্ত সৎ। তাই মনোরঞ্জের প্রয়োজনের হোকাস ফোকাস গিলি গিলি এসব বললেও শোয়ের শেষে সে বলে দিতো যে এগুলো সবই বিজ্ঞান। অলৌকিক বলে কিচ্ছু হয়না। সব্বাই যে সেকথা মানত তা নয়। কেউ কেউ এটা নন্দর অতিরিক্ত বিনয় বলেও ধরতো।
নন্দর এখন বয়েস হয়েছে। আগের মত ওরকম ভেল্কি সে আর দেখতে পারেনা। এদিকে অর্থের অনটনটাও প্রচুর বেড়েছে। হাতে তেমন শো নেই। বাজারে নতুন জাদুকর এসেছে কল্লোল বাগচী। সব শো হাউসফুল যায়। নন্দ যা খেলা দেখাত সে প্রায় সব খেলাই দেখায়।
কিন্তু কল্লোল বাগচী এক জায়গায় গিয়ে ডাহা ফেল করে যায়। আর সেটা হলো মানুষ কেটে জোড়া লাগাবার খেলাটা সে পারেনা। মনে মনে অনেক উপায় সে ভেঁজেছে কিন্তু কোনোদিন সাহস করেনি সেই খেলা দেখতে। হাজার হোক মানুষের প্রাণ নিয়ে তো আর ছেলে খেলা করা যায়না।
অনেক ভেবে চিন্তে বাগচী ঠিক করলো সে নন্দর স্মরণাপন্ন হবে। তার আত্মশ্লাঘাতে একটু আঘাত লাগবে কিন্তু এই খেলাটা তাকে শিখতেই হবে।
পরদিন সে হাজির হলো নন্দর রিষড়ার বাড়িতে। নন্দ তখন একটা নিম কাঠি নিয়ে দাঁতন করছে। কল্লোল বাগচীকে দেখে নন্দ অবাক হলেও সেই ভাব লুকিয়ে প্রশ্ন করলো ,” এখানে কি মনে করে ? তুমি তো এখন বিখ্যাত মানুষ। আমার মতো ছাপোষা লোকের বাড়ি এলে লোকে কি বলবে ?”
কল্লোল বাগচী এই খোঁচাটা একরকম অগ্রাহ্য করে ঢপাস্ করে প্রণাম করে বসলো। তারপর বিনয়ে গদগদ হয়ে বললো ,” কি যে বলেন। আপনারা হলেন পথ প্রদর্শক। আমি তো সবে শুরু করেছি। আপনাকে ছুঁতে ঢের দেরি আছে। “
নন্দ দাঁতনটা ফেলে জল দিয়ে মুখ কুলি করতে করতে বললো ,”বটে ”
বাগচী বুঝলো তার ভাষণে কাজ দিয়েছে। তাই সে কোনো সময় অপচয় না করে সোজাসুজি আসল কথায় চলে এলো।
-“আমি আপনার কাছে নাড়া বাঁধতে চাই। মানুষ কাটার ম্যাজিকটা একটু শিখিয়ে দেন যদি। ”
নন্দ বিড়বিড় করে বললো ,” মরা হাতির প্রবাদটা তাহলে মিথ্যে নয়।”
তারপর কল্লোলের দিকে তাকিয়ে বললো ,”কিন্তু তোমায় শেখাবো কেন ?”
কল্লোল খুব সুন্দর কথা বলতে পারে। সে বললো ,”কারণ আজ থেকে আপনি আমার গুরুদেব আর আপনি বেঁচে থাকবেন আপনার শিষ্য মানে আমার মাধ্যেমে। আমি আনুষ্ঠানিক ভাবে ঘোষণা করবো আপনিই আমার গুরুদেব।”
ব্যাস ওতেই নন্দর মন গলে গেলো। “ভেতরে চলো ” বলে নন্দ আর কল্লোল ঘরে ঢুকলো।
যে খেলার কৌশল কল্লোল এতোদিনেও রপ্ত করতে পারেনি সেটা নন্দর থেকে শিখতে লাগলো ঠিক তিন ঘন্টা চল্লিশ মিনিট। আনন্দে আত্মহারা কল্লোল বাগচী নন্দর হাতে একটা পাঁচশো টাকার নোট দিয়ে বললো ,”এই গুরুদক্ষিণাটুকু রেখে দিন। কাল চন্দননগরে শো আছে। এই খেলাটা দেখাবো। অবশ্যই আসবেন। আমি গাড়ি পাঠিয়ে দেব। “
নন্দ বললো ,”কালকেই দেখাবে ? এটা একটু বিপজ্জনক খেলা। কদিন আগে প্র্যাকটিস করে নাও।“
কল্লোল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো ,”তার উপায় নেই। ওরা এই খেলাটার নাম দিয়ে প্রচার করেছে। তাইতো তড়িঘড়ি আপনার কাছে এলাম। ”
নন্দ পাঁচশো টাকা পেয়ে এতটাই আবেগপ্লুত হয়ে উঠেছে যে সে বললো ,”তাহলে এক কাজ করো। তুমি কাটার খেলাটা আমাকে দিয়ে দেখাও। আমি বাক্সবন্দী থাকবো। কোনো গন্ডগোল হলে আমি ম্যানেজ দিয়ে দেব। ”
কল্লোল এতটা সাহায্য আশা করেনি। সে আরও পাঁচশো টাকা হাতে দিয়ে নন্দকে আরও একবার ঢিপ করে প্রণাম করে বিদায় নিলো। যাবার আগে আবার বলে গেলো , “কাল সন্ধ্যে ছটায় শো। পাঁচটায় গাড়ি পাঠিয়ে দেবো।”
নন্দ দু হাত তুলে আশীর্বাদ করার ভঙ্গিতে বললো,”আচ্ছা তাই হবে |”
পরের দিন যথা সময়ে শো শুরু হলো। হল পুরো হাউসফুল। কল্লোল বাগচী একের পর এক খেলা দেখিয়ে চলেছে। হাততালিতে ফেটে পড়ছে প্রেক্ষাগৃহ। আর এক একটা খেলার পর আওয়াজ উঠছে ,”মানুষ কাটার খেলা দেখতে চাই !”
কিন্তু নন্দ কোথায় ? সে তো এখনো আসেনি। প্রায় সাতটা বাজে। রিষড়া থেকে চন্দননগর গাড়ি করে এতটা সময় লাগার কথা নয়। তাহলে কি লোকটা ঝুলিয়ে দিলো। হাজার টাকা নিয়ে বেইমানি করলো ? প্রতিশোধ নিলো তার কাজগুলো কেড়ে নেবার জন্য ? কল্লোলের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। আর বেশিক্ষন অন্য ম্যাজিক দিয়ে চালানো সম্ভব নয়। বড়োজোর আর দুটো খেলা সে দেখতে পারবে। শেষ খেলা দেখাবার সময় কল্লোল দেখলো উইংসের পাশে নন্দ দাঁড়িয়ে। যাক নিশ্চিন্ত। তাই সে সদর্পে ঘোষণা করলো এবার মানুষ কাটার খেলা। টানা দু মিনিট হাততালি চললো।
কল্লোল নন্দকে একটা তক্তপোষে শুইয়ে ওপরে একটা বাক্স চাপা দিলো। এবার এলো একটা কাটিং মেশিন। গোল ধারালো দাঁতওয়ালা একটা চাকা। সেটাতে ইলেক্ট্রিক সুইচ টিপতেই চাকা ঘরঘর শব্দে ঘুরতে ঘুরতে নামতে শুরু করলো। যে বাক্স দিয়ে নন্দকে চাপা দেয়া ছিল সেটা এফোঁড় ওফোঁড় করে দিলো। কল্লোল বাক্সে দুবার চাপড় মারলো। বাক্সর ফাঁক দিয়ে নন্দর এবার হাত বের করে নাড়ার কথা। আর তারপর শরীরের ওপর দিকটা থেকে মুখ বার করে এদিক ওদিক ঘুরিয়ে জীবন্ত থাকার প্রমাণ দেবার কথা। কিন্তু সেসব কিছুই হলোনা। যেটা ঘটলো তাতে কল্লোল বাগচী পর্যন্ত চমকে গেলো।
বাক্স কাটা অবস্থায় দুদিকে সরে গেলো। তক্তপোষে অক্ষত অবস্থায় শুয়ে নন্দ সান্যাল। কিন্তু সত্যি কি অক্ষত ? ওটা কি হচ্ছে ? নন্দ উঠে বসলো। তারপর নামলো তক্তপোষ থেকে। কিন্তু পুরো দেহ নয়। অর্ধেক। পেট থেকে পা অবধি খাটে শুয়ে। মাথা থেকে বুক নিচে নেমেছে। দু হাতের চাপে সেটা এগিয়ে এলো স্টেজের ধারে। দু হাত তুলে নাড়লো দর্শকদের উদ্যেশ্যে। হলে এক অদ্ভুত নীরবতা। সবাই বিস্ময়ে হতবাক। হাততালি দিতেও ভুলে গেছে।
এবার বুক থেকে পা অবধি অংশটা দাঁড়ালো তক্তপোষের ওপর। সেখানেই একটু পায়চারি করে আবার শুয়ে পড়লো। ততক্ষনে ওপরের অংশটাও ফিরে গেছে। যথাস্থানে শুয়ে আবার একটা গোটা মানুষ আকার নিয়ে নেমে পড়লো তক্তপোষ থেকে। পুরো হল তখনো চুপ।
সেই নিস্তব্ধতা ভেঙে খান খান করে প্রথম হাততালি দিয়ে উঠলো কল্লোল বাগচী নিজে। সাথে সাথে হল তালিতে ফেটে পড়লো। কল্লোল বাগচীকে ভক্তরা ঘিরে ধরলো। এমন ম্যাজিক এর আগে কেউ দেখায়নি। লোকজন প্রায় মাথায় করে কল্লোলকে নিয়ে বেরোলো হল থেকে তার নামে জয়ধ্বনি করতে করতে।
কল্লোলের কিন্তু এসবে মন নেই। সে নন্দকে খুঁজছে। এই খেলা তাকে শিখতেই হবে। যত টাকা লাগুক সে দেবে। কিন্তু নন্দর দেখা নেই।
কল্লোল এদিক সেদিক খুঁজে কোথাও পেলোনা। লোকটা কি তাহলে চলে গেলো ? সে তো বলেছিলো গাড়ি করে পৌঁছে দেবে। ওই তো ড্রাইভার। কল্লোল ভাবলো ওকেই জিগেস করা যাক।
ড্রাইভার রাকেশ অন্যমনস্ক ভাবে দাঁড়িয়েছিল। কল্লোল পেছন থেকে তার কাঁধে হাত রাখতেই চমকে তাকালো। উদভ্রান্ত কল্লোল জিগেস করলো ,”যে বাবুটাকে নিয়ে এলি সে গেলো কই ?”
ড্রাইভার কাঁপা গলায় বললো ,”আনতে আর পারলাম কই বাবু ? বাড়ি থেকে বেড়িয়ে গাড়িতে ওঠার সময় আমায় বললেন একটা পান খেয়ে আসি। রাস্তার উল্টোদিকে পানের দোকান। জিটি রোড পেরোবার সময় একটা ট্রাক এসে পিষে দিলো রাস্তার সাথে। পেটের ওপর দিয়ে চাকা চলে গিয়ে বডি নাকি দুভাগ করে দিয়েছে। পুলিশ এসে বডি তুলে নিয়ে গেছে। আমি আর থাকতে না পেরে চলে এলাম। আপনি খেলা দেখাচ্ছিলেন তাই আর খবর দিইনি।”
কল্লোল বাগচী ড্রাইভারকে ধরে ঝাঁকিয়ে বললো ,”কি বলছিস তুই। লোকটা এতক্ষন ……” থামতে হলো কল্লোলকে। গাড়ির পেছনে গাছের নিচে একজন দাঁড়িয়ে। নন্দ সান্যাল। না কোনো ভুল নেই। কল্লোল দৌড়ে গেলো। নন্দর জামা রক্তে মাখা। দু চোখ স্থির। শুধু সাদা ফ্যাকাসে ঠোঁটটা নড়ছে। নন্দ বলছে “সব কিছু শেখা যায়না কল্লোল। কারণ সব বিজ্ঞান নয়। জগতে কিছু কিছু অলৌকিক ঘটনাও ঘটে।“
শেষ কথাটার সাথে একটা দমকা হাওয়ায় মিলিয়ে গেলো নন্দ সান্যাল। ভয়ে মেশানো বিস্ময়ে হতবাক হয়ে নিশ্চল পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে রইলো এ যুগের সাড়া জাগানো জাদুকর কল্লোল বাগচী।
********************************************
শান্তনু মুখোপাধ্যায় (জয়)
#SantanuStory