ভাগ্যচক্র – শান্তনু মুখোপাধ্যায় (জয় )

(গল্পের সব চরিত্র কাল্পনিক। কোন ব্যক্তি বা ঘটনার সাথে সাদৃশ্য নিতান্তই কাকতলীয় )

****************************************************************************

cropped-Blog.jpg-“ব্যাপার কি ডঃ পান্ডে? আপনি এই অসময় ?”

হুইস্কির গ্লাসে দ্বিতীয় চুমুকটা দিয়ে বললেন ডঃ সাক্সেনা |

বাড়ির সামনে বিশাল লন।  সেখানে গোলাকৃতি ছাতার নিচে রোজ সন্ধ্যাবেলা সুরা পানে বসেন  চাইল্ড হেলথ কেয়ার নার্সিংহোমের সুপার ডঃজগদীশ সাক্সেনা। সারাদিন নার্সিং হোমে কাটিয়ে এই সন্ধেটা একটু মৌতাত করেন।

ডঃ পান্ডে একটু চিন্তিত ভাবে বললেন ,” আরও দুটো ”

নির্লিপ্ত ডঃ সাক্সেনা গ্লাসটা নামিয়ে বললেন ,” কখন ?”

– “সন্ধ্যেবেলা। একটু আগে ”

– ” টোটাল কত হলো ”

– ” বাইশ।  টোয়েন্টি টু ”

– “হুম ”

– ” কিছু একটা করুন স্যার। যেখান থেকে হোক অক্সিজেন আনান। এভাবে একটার পর একটা শিশুগুলো মারা যাচ্ছে। এতো মেনে নেয়া যায়না” আর্তনাদের মতো বলে উঠলেন ডঃ পান্ডে।

ডঃ সাক্সেনার কপালে হালকা ভ্রুকুটি দেখা গেলো। উল্টোদিকের চেয়ারটা এগিয়ে দিয়ে ডঃ পান্ডেকে বসতে বলে বললেন, ” আপনার জন্যহুইস্কি ঢালি ?”

সম্ভ্রমের সীমা ছাড়িয়ে ডঃ পান্ডে চেঁচিয়ে উঠলেন ,” আপনি কি মস্করা করছেন ? একটার পর একটা মায়ের কোল খালি হয়ে যাচ্ছে আর আপনিআমায় হুইস্কি অফার করছেন ?”

ডঃ সাক্সেনা মৃদু হেসে বললেন ,” মহাভারত পড়েছেন ?”

– ” পড়েছি কিন্তু এখানে তার কি সম্পর্ক ?”

-” সম্পর্ক আছে ডঃ পান্ডে। ভীষ্ম জন্মাবার আগে ছয়টি শিশুকে মরতে হয়েছিল। জানেন বোধহয়। কৃষ্ণ জন্মাবার আগে সাতজন শিশু কংসেরহাতে মারা পড়েছিল।  তাই বলছি শিশু মৃত্যু নতুন কিছু নয় ! আর কি জানেন এরা সবাই ছিল ঈশ্বরের দূত। এদের পাপের জন্য শাস্তি হয় মর্ত্যএকবার জন্ম নিতে হবে। তারপরেই মুক্তি। কে জানে ; এই যে শিশুগুলো মারা যাচ্ছে এরা হয়তো আসলে মুক্তি লাভ করছে। ভবিতব্য ডঃ পান্ডেভবিতব্য। একি আপনি বা আমি খন্ডাতে পারবো ?”

ডঃ পান্ডে শ্লেষ মিশিয়ে বললেন ,”আপনার এই যুক্তি আদালতে চলবে তো ?”

ডঃ সাক্সেনা একটা ধূর্ত হাসি দিয়ে বললেন ,”চলবে কি ? চলে গেছে। যতদিন ধর্ম ব্যাপারটা জীবিত আছে ততদিন এসব সুড়সুড়িতেই কাজ হয়েযাবে। ”

ডঃ পান্ডে অসহায়ের মতো বললেন ,”তাহলে কি কোনো ব্যবস্থা নেবেন না ?”

-” ব্যবস্থা নেবার যো নেই পাণ্ডেজি ! পেছনে বড় চক্র। অক্সিজেন এখন ভালো ব্যবসা !”

বাকরুদ্ধ ডঃ পান্ডে আর কথা না বাড়িয়ে ফিরে এলেন হাসপাতালে। বাইরে তখন পুলিশ ভর্তি। সন্তান হারা মায়ের কান্নায় কান পাতা দায়। সদ্যপুত্রহারা কমলি আর তার স্বামী রাজু  পাথরের মত বসে আছে। চোখের জলও যেন শুকিয়ে গেছে। এমন সময় এম্বুলেন্সের ভোঁ শোনা গেলো।আরেকটি শিশু এসেছে। ধুম জ্বর। অক্সিজেন লাগবে। শিশুটিকে স্ট্রেচারে করে নিয়ে আসা হলো ডঃ পান্ডের কাছে আর দেখেই চমকে উঠলেনতিনি। এই শিশুকে তিনি আগেও দেখেছেন | একবার নয়। বেশ কয়েকবার। ডঃ সাক্সেনার বাড়িতে। কোনো সন্দেহ নেই এই শিশুই ডঃ সাক্সেনারনাতি ভিকি। ছেলের সাথে সদ্ভাব নেই আর তাই তারা আলাদা থাকে। কিন্তু নাতিটি তাঁর অতি প্রিয়। তাই চাকর রামশরণ বিকেলে একবার করেনিয়ে আসে দাদুর কাছে। ডঃ সাক্সেনা বলেছিলেন ,”ওইটুকু সময় আমি নতুন জীবন পাই ”

ডঃ পান্ডে ফোন করলেন ডঃ সাক্সেনাকে আর কিছুক্ষনের মধ্যেই সেখানে হাজির হলেন উদ্ভ্রান্ত সাক্সেনা। ভিকির কপালে হাত দিয়ে স্টেথোঠেকালেন বুকে আর তারপর পাগলের মতো চিৎকার করে বললেন ,”অক্সিজেন লাও ”

কোথায় অক্সিজেন ? একটু একটু করে নীল হয়ে যাচ্ছে ভিকির দেহ। ডঃ সাক্সেনা ড্রাইভারকে বললেন ,”গাড়ি নিকালো। অভি ইসকো শহর লেযানা হ্যায় ”

নিজেই পাঁজাকোলা করে তুলে নিলেন ভিকিকে। সামনে দরজা। বেরিয়েই গাড়ি। কিন্তু একি ? দরজা আগলে দাঁড়িয়ে ডঃ পান্ডে।

হিমশীতল গলায় বললেন ,” কোথায় যাচ্ছেন স্যার ? ও তো দেবতার দূত। ওকে মুক্তি দিন। এযে ওর ভবিতব্য। ”

ডঃ সাক্সেনা প্রায় উন্মাদের  মতো বলে উঠলেন ,” সরে যাও। এসব কথা বলার সময় এটা নয়। দেখছোনা ও কেমন নীল হয়ে যাচ্ছে ”

ডঃ পান্ডে বললেন, “ঠিক এইভাবে একটু একটু করে নীল হয়ে বাইশ জন মারা গেছে এই বেলাপুরে। কই তখন তো চোখে পড়েনি ?”

ডঃ সাক্সেনা ভিকিকে বুকে চেপে ধরে বললেন ,” ক্ষমা করে দাও। আমার পাপের শাস্তি  এই শিশুটাকে দিওনা।  ও তো নিষ্পাপ ”

-” যানে দিজিয়ে ডঃ সাব। অভি যায়গা তো বাঁচ সাকতা হ্যায় ”

কথাটা এলো পেছন থেকে এক মহিলা কণ্ঠে। চকিতে ঘুরে তাকালেন ডঃ পান্ডে। কখন সেখানে এসে দাঁড়িয়েছে কমলি আর তার স্বামী।

কমলি পাথরের মত দাঁড়িয়েই বললো , ” ঔর মা কে কোখ খালি মাত কিজিয়ে। ”

নিচে চোখ পড়তে ডঃ পান্ডে দেখলেন তাঁর পা জড়িয়ে বসে আছে ভিকির মা , ডঃ সাক্সেনার পুত্রবধূ

অজান্তেই ডঃ পান্ডের হাত নেমে গেলো। নাতিকে কোলে নিয়ে ছুটে বেরিয়ে গেলেন ডঃ সাক্সেনা।

ধোঁয়া ছেড়ে অন্ধকারে মিলিয়ে গেলো তাঁর গাড়ি।

**********************************************************************

সেদিন রাতেই হসপিটালে অক্সিজেন এলো। বাকি শিশুগুলো সুস্থ হয়ে উঠতে লাগলো একে একে। ভিকিও সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছে। ডঃ পান্ডেরএখন চরম ব্যস্ততা কারণ তিনিই নতুন সুপার। আর ডঃ সাক্সেনা ? আপাততঃ হাজতে। বিচারাধীন বন্দি হিসেবে। কিন্তু সে বিচার কতদূর হবেসেটা নিয়ে সংশয় আছে। গত কদিন তাঁর কিছু অসংলগ্ন ব্যবহার চোখে পড়ে। সবসময় কল খুলে হাত ধুতে দেখা যায়। জিগেস করলে বলেন ,”শিশুদের রক্ত লেগে আছে। ধুচ্ছি ; কিন্তু উঠছেনা ”

ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী তাঁকে আগামীকাল নিয়ে যাওয়া হবে মানসিক রুগীর হাসপাতালে। এখন কদিন সেটাই তাঁর ঠিকানা।

*************************************************************************************************************

শান্তনু মুখোপাধ্যায় (জয় )

1 comment

  1. Bibhab Chakraborty says:

    Khub bhalo laglo. Thanks to Santanu.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *