************************************
স্কুলের পর সন্ধ্যের টিউশন সেরে বাড়ি ফিরে খাটের ওপর গিফট গুলো সাজিয়ে রাখলো দূর্বা। কলকাতার নামী ইস্কুলে ইংরেজি পড়ায় সে। তারপর সোম টু শুক্র সন্ধ্যেবেলা একটা কোচিং সেন্টার-এ ক্লাস নেয় |স্বামী বিতান নাম করা পার্সোনালিটি ডেভেলপমেন্ট কন্সাল্ট্যান্ট। এটা নতুন হয়েছে আর ক্রেজ ভালোই। অনেক মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানি বিতানের ক্লায়েন্ট। কাজের প্রয়োজনে প্রায়ই তাকে বাইরে যেতে হয়। আজি সে ফিরেছে গোয়াতে একটা কনফারেন্স সেরে।
খাটে এতো গিফট দেখে বিতান টাইয়ের নটটা আলগা করতে করতে দুর্বাকে জিগেস করলো, “এতো গিফট কিসের ?”
দূর্বা আনমনে গিফটগুলোর ওপর হাত বোলাচ্ছিলো। বিতানের প্রশ্নে চমকে তাকিয়ে বললো , “ওমা ভুলে গেলে আজ তো ফিফথ সেপ্টেম্বর। টিচার্স ডে। এগুলো আমার স্টুডেন্টরা আমায় দিয়েছে। ”
-” বাঃ ভালোই ” বলে বাথরুমে ঢুকে গেলো বিতান।
দূর্বা ব্যস্ত হয়ে পড়লো গিফটগুলো গোছাতে।
ঠিক সেই সময় একটা শিশু কণ্ঠে কে যেন বলে উঠলো, “মা আমায় একটা গিফট দেবে ?”
দূর্বা চমকে তাকিয়ে দেখলো টুবাই এসেছে। টুবাই বিতান আর আর দুর্বার এক মাত্র সন্তান। ক্লাস টুতে পড়ে।
দূর্বা টুবাই এর দিকে তাকিয়ে বললো ,”এমা। আমি তো টুবাই বাবুর কথা ভুলেই গেছিলাম। সেই কাল রাতে দেখেছিলাম। সকালে যখন বেরোলাম তখনো টুবাই বাবু ঘুমোচ্ছে। আমার দুঃখ হয়না বুঝি। ”
শিশুটি কি বুঝলো কে জানে ? সেও একটু অভিমানী গলায় বললো “আমারো খুব কষ্ট হয় মা। তোমাকে আর বাবাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করে।”
দূর্বা সাথে সাথে টপিক পাল্টে ছেলেকে বলে ,”কোন গিফটটা নিবি বল ”
টুবাই অনেক ভেবে একটা নীল রঙের মাথার কাঁটা তুলে নেয়।
অবাক হয়ে দূর্বা জিগেস করলো ,”এমা ! তুই মেয়েদের মাথার কাঁটা কি করবি ?”
টুবাই হাতের মুঠোয় কাঁটাটা ধরে উত্তর দিলো ,” টিচারকে দেবো। তুমি যে বললে আজ টিচার্স ডে ”
দূর্বা মুচকি হেসে বললো ,”আচ্ছা। আমি সুন্দর করে গিফট প্যাক করে দেবো। ”
হাতে কাঁটাটা নিয়ে ঘর থেকে দৌড়ে পালালো টুবাই।
রাতে ডিনার টেবিলে দূর্বা বসেছে বিতানকে নিয়ে।
টুবাইকে খাইয়ে দিয়েছে মিনতি। মিনতি টুবাই জন্মাবার পর থেকেই এখানে থাকে। চাকরিতে বহাল হয়েছিল আয়ার কাজ নিয়ে। এখন সে ২৪ ঘন্টার খাওয়া পরার কাজের লোক। সারাদিন রান্না ছাড়াও তার মূল কাজ টুবাইয়ের খেয়াল রাখা। টুবাইকে ঘুম পাড়াতে গিয়ে সে শুনলো দূর্বা চিৎকার করে ডাকছে ,” মিনতি। ফ্রিজ থেকে একটু পায়েসের বাটিটা দিয়ে যাও তো !”
মিনতি উঠে এসে, ফ্রিজ খুলে, পায়েসের বাটি টেবিলে রেখে সবে ঘুরেছে , সাথে সাথে কি একটা দেখে চমকে উঠলো দূর্বা। মিনতির মাথায় নীল রঙের কাঁটা ,যেটা একটু আগে টুবাই নিয়ে গেছে টিচারকে দেবে বলে।
দূর্বা সোজাসুজি জিগেস করতে গিয়েও থমকে গেলো। নাঃ এভাবে জিগেস করা ঠিক না। সে বললো ,”মিনতি তুমি খেয়ে শুয়ে পড়। আজ টুবাইকে আমি ঘুম পড়াবো।”. এই বলে ঢুকে গেলো টুবাইয়ের ঘরে।
কিছুক্ষন টুবাই এর মাথায় হাত বুলিয়ে দূর্বা জিগেস করলো ,”নীল কাঁটাটা কোথায় রে যেটা তুই বললি টিচারকে দেবো .”
-“দিয়ে দিয়েছি তো ” টুবাই -এর সরল স্বীকারোক্তি |
দুরু দুরু বুকে দূর্বা জিগেস করলো “কাকে ?”
টুবাই উত্তর দিলো ,”মিনুমাকে ”
-“মিনুমা ? “এই নামেই তো টুবাই মিনতিকে ডাকে।
দূর্বা একটু বিরক্তি দেখিয়ে বললো ,”কিন্তু তুমি নিলে তো টিচারকে দেবে বলে ”
টুবাই অবাক হয়ে বললো ,” এমা তুমি জানোনা ? মিনুমাও টিচার। আমায় হাত দিয়ে ভাত খেতে শিখিয়েছে , ঠিক যেমন করে আমার পাশের বাড়ির বন্ধু রাহুলের মা শিখিয়েছে। রাহুলের বাবা ওকে সাইকেল চড়া শিখিয়েছে। মিনুমা আমায় শিখিয়েছে। মিনুমা আমায় সব সময় সত্যি কথা বলা শিখিয়েছে। তাই মিনুমাও টিচার আর ওকেও গিফট দিতে হবে। ”
কিছুক্ষন পুরো নিস্তব্ধতা। টুবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। দূর্বা ফিরে এলো ওর নিজের ঘরে। বিতান ল্যাপটপ থেকে একবার চোখ তুলে জিগেস করলো ,”কি হলো চোখে জল কেন ?”
কোনো উত্তর দিলোনা দূর্বা। বিতান আবার কাজে ডুবে গেছে। চোখে জল দেখেও সে দ্বিতীয় বার আর জিগেস করলো না কারনটা। দূর্বা মনে মনে ভাবলো কি পৃথিবীতে বাস করছি আমরা। যেখানে স্ত্রীর চোখের জলের কোনো মূল্য তার স্বামীর কাছে নেই। যেখানে ছেলে মায়ের থেকে কাজের মাসিকে বেশি আপন বলে জানে। ”
এই সব ভাবতে ভাবতেই দরজায় টোকা পড়লো। দূর্বা উঠে গিয়ে দরজা খুলতেই দেখলো মিনতি দাঁড়িয়ে। হাতে নীল রঙের সেই কাঁটা । দুর্বাকে বললো ,”টুবাই সোনা এটা জোর করে মাথায় গুঁজে দিয়ে গেছিলো। এটা বোধ হয় আপনার ”
দূর্বা কাঁটাটা মিনতির হাতে আবার দিয়ে তার ডান হাতের মুঠিটা ধরে ফেললো। দু চোখে জল। কোনো ভাবে নিজেকে সামলে সে বললো ,”মিনতি ,আমি তো মা-ই হয়ে উঠতে পারলামনা। তুমি তো ওর কাছে ওর টিচার হয়ে উঠেছো। এই উপহার তুমি রাখো। আমি বা বিতান কেউই আজ আর চাকরির সাথে আপস করতে পারবোনা। লোভ বড় সাংঘাতিক জিনিস। আমার ছেলেটাকে তুমি-ই ভালো করে মানুষ করো ”
দুর্বার কথায় দুবার মাথা নাড়িয়ে পেছনে ঘুরলো মিনতি। বিয়ের দু বছরের মধ্যে এক দুর্ঘটনায় স্বামী আর পুত্র হারানো অভাগী আজ যেন পুনর্জন্ম পেলো।
***************************************
শান্তনু মুখোপাধ্যায় (জয়)
#SantanuStory